03 Jul, 2025
জ্বর আমাদের শরীরের একটি প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়া, যা সাধারণত সংক্রমণের বিরুদ্ধে শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অংশ হিসেবে ঘটে। তবে, যখন শরীরের তাপমাত্রা ১০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট (প্রায় ৩৯.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস) ছাড়িয়ে যায়, তখন এটি একটি উচ্চমাত্রার জ্বর হিসেবে বিবেচিত হয়।
এ ধরণের উচ্চ জ্বর শিশু, বৃদ্ধ, এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এমন ব্যক্তিদের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। এতে শরীরে পানিশূন্যতা, খিঁচুনি, মস্তিষ্কে চাপ ও অন্যান্য জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই ১০৩ ডিগ্রি জ্বরকে অবহেলা না করে দ্রুত সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
১০৩ ডিগ্রি জ্বর সাধারণত শরীরের অভ্যন্তরীণ সংক্রমণের ইঙ্গিত দেয়। এর সাথে সাধারণত নিম্নোক্ত উপসর্গগুলো দেখা যায়:
প্রচণ্ড কাঁপুনি ও ঘাম
মাথা ব্যথা ও শরীরে যন্ত্রণা
দুর্বলতা ও ক্লান্তি
ক্ষুধামান্দ্য (ক্ষুধা কমে যাওয়া)
চোখে জ্বালা বা ঝাপসা দেখা
হাড়ে ও গাঁটে ব্যথা
দ্রুত শ্বাসপ্রশ্বাস বা হৃদস্পন্দন
ঘুমে সমস্যা
শিশুদের ক্ষেত্রে খিটখিটে মেজাজ, কান্না বা খিঁচুনি
এসব লক্ষণ দেখে জ্বরের মাত্রা সম্পর্কে আন্দাজ করা গেলেও থার্মোমিটারে মেপে নিশ্চিত হওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
জ্বর সঠিকভাবে পরিমাপ করা চিকিৎসার জন্য অত্যন্ত জরুরি। তাপমাত্রা পরিমাপের জন্য থার্মোমিটার ব্যবহারের নিয়ম জানা থাকা দরকার। নিচে বিভিন্ন পদ্ধতির ব্যাখ্যা দেওয়া হলো:
ডিজিটাল থার্মোমিটার: সবচেয়ে প্রচলিত ও নির্ভরযোগ্য।
মার্কারি থার্মোমিটার: সাবধানতার সাথে ব্যবহারযোগ্য, ভেঙে গেলে বিপজ্জনক হতে পারে।
ইনফ্রারেড (কান বা কপালে স্ক্যানার): শিশুর জন্য দ্রুত ও সহজ।
মৌখিকভাবে (মুখে): থার্মোমিটার জিহ্বার নিচে রেখে ১-২ মিনিট।
বগলে (আন্ডারআর্ম): ২-৩ মিনিট রেখে মাপা, তবে এটি তুলনামূলকভাবে কম সঠিক।
মলদ্বারে (রেক্টাল): শিশুদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য, তবে সাবধানে করতে হয়।
খাবার, পানীয় বা ব্যায়ামের পর কমপক্ষে ১৫ মিনিট অপেক্ষা করে মাপা উচিত।
থার্মোমিটার ব্যবহার শেষে জীবাণুমুক্ত করতে ভুলবেন না।
১০৩ ডিগ্রি জ্বর সাধারণত শরীরে কোনো গুরুতর সংক্রমণের ইঙ্গিত দেয়। এটি ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা অন্যান্য প্যাথোজেনের কারণে হতে পারে। নিচে কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ ব্যাখ্যা করা হলো:
ভাইরাস দ্বারা সংক্রমণের ফলে শরীরে জ্বর দেখা দেয়। যেমন:
ইনফ্লুয়েঞ্জা (Flu)
করোনা ভাইরাস
ভাইরাল কোল্ড বা সর্দি-কাশিজনিত জ্বর
চিকুনগুনিয়া
এগুলো সাধারণত শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দ্বারা কয়েক দিনের মধ্যে সেরে যায়, তবে জ্বর বেশি হলে সতর্ক হওয়া জরুরি।
ব্যাকটেরিয়ার কারণে সৃষ্ট জ্বর বেশি দীর্ঘস্থায়ী ও তীব্র হয়। উদাহরণ:
গলা ব্যথা বা টনসিলাইটিস (স্ট্রেপ্টোকক্কাল ইনফেকশন)
ইউরিন ইনফেকশন (UTI)
নিউমোনিয়া (Bacterial Pneumonia)
এই অবস্থায় সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসা প্রয়োজন হয়।
এই রোগগুলো ১০৩ ডিগ্রি বা তার বেশি জ্বর সৃষ্টি করতে পারে:
ডেঙ্গু: হঠাৎ করে প্রচণ্ড জ্বর, চোখের পেছনে ব্যথা, শরীরে ফুসকুড়ি।
টাইফয়েড: দীর্ঘস্থায়ী জ্বর, দুর্বলতা, পেট খারাপ বা কোষ্ঠকাঠিন্য।
নিউমোনিয়া: শ্বাসকষ্ট, কাশি, বুকে ব্যথা সহ উচ্চ জ্বর।
এই ধরনের জ্বর হলে রোগ নির্ণয়ের জন্য রক্ত পরীক্ষা ও চিকিৎসকের পরামর্শ অত্যন্ত জরুরি।
১০৩ ডিগ্রি জ্বর হলে তাৎক্ষণিক কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় এবং জটিলতা এড়ানো যায়।
শরীর তখনই ভালোভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে, যখন পর্যাপ্ত বিশ্রামে থাকে। জ্বরের সময় বিছানায় বিশ্রাম নেওয়া সবচেয়ে ভালো।
জ্বর হলে শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। তাই প্রচুর পানি, নারকেলের পানি, স্যুপ, ওরস্যালাইন খেতে হবে। এটা শরীর ঠান্ডা রাখে ও রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে।
জ্বরের সময় ভারী ও মসলাযুক্ত খাবার না খেয়ে সহজপাচ্য ও পুষ্টিকর খাবার (যেমন খিচুড়ি, ডাল, সেদ্ধ সবজি, স্যুপ) খাওয়া উচিত। এতে হজমের চাপ কমে এবং শরীর দ্রুত শক্তি ফিরে পায়।
কপালে ঠান্ডা পানিতে ভেজানো কাপড় দিন।
থার্মোমিটার দিয়ে নিয়মিত তাপমাত্রা পরিমাপ করুন।
অতিরিক্ত ঘাম বা বমি হলে ওরস্যালাইন খাওয়ান।
জ্বর হলে অনেকেই প্রথমে ওষুধ না খেয়ে প্রাকৃতিকভাবে উপশম করার চেষ্টা করে থাকেন। বিশেষ করে হালকা থেকে মাঝারি জ্বর হলে নিচের ঘরোয়া উপায়গুলো বেশ কার্যকর হতে পারে:
একটি পাতলা তোয়ালে বা কাপড় ঠান্ডা পানিতে ভিজিয়ে নিয়ে কপাল, গলা, বগল এবং হাত-পায়ে মুছুন।
এই পদ্ধতি শরীরের তাপমাত্রা কমাতে সাহায্য করে। তবে সরাসরি বরফ বা খুব ঠান্ডা পানি ব্যবহার করা উচিত নয় — এতে শক লাগতে পারে।
আদা চা: আদা অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি এবং অ্যান্টিভাইরাল বৈশিষ্ট্যযুক্ত। এটি শরীর গরম রাখে ও ঘাম এনে জ্বর কমাতে সহায়তা করে।
তুলসী চা: তুলসী পাতা জ্বরের বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং শরীরের প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়।
উপায়: পানি ফুটিয়ে তাতে কিছু আদা কুচি বা ৫-৬টি তুলসী পাতা দিন। ৫-৭ মিনিট ফুটিয়ে ছেঁকে দিনে ২-৩ বার খেতে পারেন।
শরীরকে জ্বর থেকে মুক্ত হতে হলে বিশ্রাম ও সহজপাচ্য খাবার অপরিহার্য। গরম স্যুপ, খিচুড়ি, ডাবের পানি এসব প্রাকৃতিকভাবে শরীর সুস্থ করে।
সব জ্বরই যে ঘরোয়া চিকিৎসায় ভালো হয়ে যাবে, তা নয়। কিছু জটিল উপসর্গ বা অবস্থা দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া খুবই জরুরি।
ছোট শিশু ও বয়স্কদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকায় তাদের জ্বর হলে অবিলম্বে ডাক্তার দেখানো উচিত। বিশেষ করে যখন:
শিশু ৩ মাসের নিচে এবং জ্বর ১০০.৪°F (৩৮°C) এর বেশি
খাওয়া-দাওয়া বন্ধ, ঘুম বেশি, অস্বাভাবিক কান্না বা ঘুমন্ত ভাব
যদি জ্বর তিনদিনের বেশি স্থায়ী হয় বা কমে আবার বাড়ে, তবে তা কোনো গুরুতর সংক্রমণের ইঙ্গিত হতে পারে — যেমন টাইফয়েড, ডেঙ্গু, নিউমোনিয়া ইত্যাদি।
নিচের যেকোনো একটি উপসর্গ দেখা দিলে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করুন:
বারবার বমি হওয়া
শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া
শরীর কাঁপা বা খিঁচুনি
তীব্র মাথা ব্যথা বা ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া
শরীরে র্যাশ বা রক্তপাতের লক্ষণ
জ্বরের সময় ভুল অভ্যাস বা অসাবধানতা শরীরের অবস্থাকে আরও খারাপ করে দিতে পারে। তাই নিচের কাজগুলো অবশ্যই এড়িয়ে চলুন:
অনেকে জ্বর কমাতে শরীর ঢেকে রাখেন, যা উল্টো শরীরের তাপমাত্রা আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। বরং হালকা ঢিলেঢালা পোশাক পরা উচিত।
অনেকেই জ্বর কমাতে সরাসরি বরফের পানি ব্যবহার করেন — এটি বিপজ্জনক হতে পারে। বরং হালকা কুসুম গরম বা স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানি ব্যবহার করুন।
জ্বরের সময় হজমের ক্ষমতা কমে যায়। অতিরিক্ত তেল-মসলাযুক্ত খাবার খাবেন না, এতে বমি বা পেটের সমস্যা হতে পারে।
ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া নিজে নিজে ওষুধ খাওয়া বিপজ্জনক। কারণ সব জ্বরের চিকিৎসা এক নয়। ভুল ওষুধে সমস্যা আরও জটিল হতে পারে।
জ্বর হলে শরীর বিশ্রাম চায়। অতিরিক্ত পরিশ্রম করলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যেতে পারে।
জ্বর একবার ভালো হলে আবার যেন না হয় — সে জন্য প্রয়োজন সচেতনতা। নিচে কিছু প্রয়োজনীয় সতর্কতা দেওয়া হলো:
খাওয়ার আগে ও বাইরে থেকে ফিরে ভালোভাবে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে।
নিজের ঘর, বিছানা, পোশাক ইত্যাদি সব সময় পরিষ্কার রাখুন। মশা নিয়ন্ত্রণে রাখুন (বিশেষ করে ডেঙ্গুর সময়)।
পুষ্টিকর ও ভিটামিনযুক্ত খাবার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। ফাস্টফুড ও রাস্তার খোলা খাবার এড়িয়ে চলুন।
অসুস্থতার বড় কারণই হচ্ছে দূষিত পানি। তাই সবসময় ফুটানো বা ফিল্টারকৃত পানি পান করুন।
শরীর সুস্থ রাখার জন্য পর্যাপ্ত ঘুম ও হালকা ব্যায়াম গুরুত্বপূর্ণ।
জ্বর, বিশেষ করে ১০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তার বেশি হলে বিষয়টি অবহেলা করার মতো নয়। জ্বর শরীরের একটি সতর্ক সংকেত — সময়মতো যত্ন ও সঠিক পদক্ষেপ নিলে এটি সহজেই নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।
মূল করণীয়গুলো সারসংক্ষেপে:
তাপমাত্রা মেপে সঠিক জ্বর নির্ণয় করুন
বিশ্রাম, পর্যাপ্ত পানি ও হালকা খাবার নিন
প্রাকৃতিক উপায়ে জ্বর উপশমের চেষ্টা করুন
জ্বর দীর্ঘস্থায়ী হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন
পরিচ্ছন্ন জীবনযাপন ও সচেতনতা বজায় রাখুন
স্বাস্থ্যই সম্পদ — তাই জ্বরকে অবহেলা না করে যত্ন নিন, সতর্ক থাকুন এবং দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন।