29 May, 2025
২৫ জন নবী রাসুলের জীবনী | কুরআনে উল্লিখিত নবীদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়
মোট নবীর সংখ্যা সম্পর্কে কুরআন বা হাদিসে নির্দিষ্ট সংখ্যা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়নি, তবে কিছু হাদিসে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।
ইবনে হিব্বান ও মুসনাদে আহমাদ-এর একটি সহীহ হাদীস অনুযায়ী:
- মোট নবীর সংখ্যা: ১,২৪,০০০ জন
এর মধ্যে রাসূল (যাদের উপর কিতাব নাজিল হয়েছে): ৩১৫ জন
তবে এই সংখ্যা নির্ভরযোগ্য হাদিস সূত্রে এলেও কুরআনে মাত্র কিছু সংখ্যক নবীর নামই উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআনে প্রায় ২৫ জন নবীর নাম এসেছে। তাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলেন:
- হজরত আদম (আ.)
- হজরত নূহ (আ.)
- হজরত ইব্রাহিম (আ.)
- হজরত মূসা (আ.)
- হজরত ঈসা (আ.)
- হজরত মুহাম্মদ (সা.)
সারসংক্ষেপে:
- মোট নবী: আনুমানিক ১,২৪,০০০ জন
- রাসূল: আনুমানিক ৩১৫ জন
- কুরআনে নাম উল্লেখ: ২৫ জন
কুরআনে উল্লিখিত ২৫ জন নবীর নাম:
· আদম (আ.)
· ইদ্রীস (আ.)
· নূহ (আ.)
· হুদ (আ.)
· ছালিহ (আ.)
· লুত (আ.)
· ইব্রাহিম (আ.)
· ইসমাঈল (আ.)
· ইসহাক (আ.)
· ইয়াকুব (আ.)
· ইউসুফ (আ.)
· আইয়ুব (আ.)
· শুয়াইব (আ.)
· মূসা (আ.)
· হারুন (আ.)
· যাকারিয়া (আ.)
· ইয়াহইয়া (আ.)
· ঈসা (আ.)
· ইলিয়াস (আ.)
· আল ইয়াসা (আ.)
· ইউনুস (আ.)
· লূকমান (আ.) (অনেক মত অনুযায়ী তিনি নবী নন, হেকিম ছিলেন)
· ইউশা (আ.) (সব মত অনুযায়ী তিনি কুরআনে সরাসরি নামসহ উল্লিখিত নন)
· দাউদ (আ.)
· সুলাইমান (আ.)
· মুহাম্মদ (সা.)
হজরত আদম (আ.) - মানবজাতির সূচনা
সৃষ্টি ও জান্নাতে অবস্থান
আল্লাহ তাআলা মাটি দিয়ে হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করেন। তিনি ছিলেন প্রথম মানুষ ও প্রথম নবী। সৃষ্টি শেষে আল্লাহ তাঁকে রূহ ফুঁকে দেন এবং আদম (আ.) প্রাণ লাভ করেন। আল্লাহ তাকে জ্ঞান দিয়েছিলেন এবং বিভিন্ন জিনিসের নাম শিক্ষা দেন।
আল্লাহ আদেশ করেন ফেরেশতাদের,
"তোমরা আদমকে সেজদা কর।"
সব ফেরেশতা সেজদা করলেও ইবলিস (শয়তান) অহংকার করে অমান্য করে। তখন থেকেই সে আদম (আ.) ও তাঁর সন্তানদের চিরশত্রু হয়ে ওঠে।
আদম (আ.)-এর জন্য জান্নাতে হাওয়া (আ.) কে সৃষ্টি করা হয়। তারা জান্নাতে বাস করতেন। কিন্তু শয়তানের প্ররোচনায় তারা এক গাছের ফল খেয়ে ফেলেন, যেটি ছিল নিষিদ্ধ।
পৃথিবীতে আগমন
এই ভুলের কারণে আল্লাহ তাদের পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেন, তবে তাদেরকে ক্ষমা করে দেন। পৃথিবীতেই তাদের বংশধারা বিস্তার লাভ করে — এখান থেকেই মানব ইতিহাসের সূচনা।
শিক্ষণীয় দিক:
- তাওবা (পশ্চাৎপস্তুতি): ভুল করলেও অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাইলে আল্লাহ ক্ষমা করেন।
- জ্ঞান ও মর্যাদা: আল্লাহ আদম (আ.)-কে জ্ঞান দিয়েছিলেন — জ্ঞান মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধি করে।
- শয়তানের প্রতারণা: মানুষকে শয়তানের ফাঁদ থেকে সতর্ক থাকতে হবে।
হজরত ইদ্রীস (আ.) – জ্ঞানের বাতিঘর
পরিচয় ও বংশধারা
হজরত ইদ্রীস (আ.) ছিলেন হজরত আদম (আ.)-এর ঘনিষ্ঠ বংশধর। বলা হয়, তিনি ছিলেন আদম (আ.)-এর তৃতীয় বা চতুর্থ প্রজন্মের সন্তান। তাঁর আসল নাম ছিল আখনূখ (اخنوخ)। কুরআনে তাঁর নাম দু’বার এসেছে (সূরা মারিয়াম ও সূরা আম্বিয়া)। আল্লাহ তাঁকে নবুয়ত দান করেন এবং মানুষের মাঝে হিদায়াত পৌঁছানোর দায়িত্ব দেন।
জ্ঞান, প্রযুক্তি ও সভ্যতা গঠনে ভূমিকা
ইদ্রীস (আ.) ছিলেন ব্যতিক্রমধর্মী নবী। তিনি শুধু ধর্মীয় দিক থেকে নয়, বরং জ্ঞান, বিজ্ঞান ও উন্নত সভ্যতার জনক হিসেবে পরিচিত।
তিনি যা প্রথম শুরু করেন:
- লেখা-পড়া: তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি লিখতে ও পড়তে জানতেন। মানুষকে তিনি লেখার কৌশল শেখান।
- দর্জির কাজ: তিনি ছিলেন প্রথম দর্জি — নিজ হাতে পোশাক সেলাই করতেন এবং অন্যদেরও তা শেখাতেন।
- সময় গণনা: তিনি দিন, সপ্তাহ, মাস ও বছর গণনার নিয়ম চালু করেন।
উত্থান ও আসমানে গমন
হজরত ইদ্রীস (আ.) ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক ও ধ্যানী। তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন তাঁকে আরো বেশি নেক আমল করার সুযোগ দেওয়া হোক।
হাদীস ও ব্যাখ্যামতে, আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করে তাঁকে জীবিত অবস্থায়ই চতুর্থ আসমানে উঠিয়ে নেন।
কুরআন বলে:
“আমি তাকে এক উচ্চ মর্যাদায় উন্নীত করেছি।”
(সূরা মারিয়াম: ৫৭)
শিক্ষণীয় দিক:
- শিক্ষা ও প্রযুক্তির গুরুত্ব: ইদ্রীস (আ.) দেখিয়েছেন যে নবীরা শুধু দাওয়াতদাতা ছিলেন না, তারা ছিলেন সভ্যতা ও জ্ঞানের পথপ্রদর্শক।
- কর্ম ও সাধনার মুল্য: নিজের জীবিকা নিজে করতেন — দর্জির কাজ করতেন। এটা শেখায়, হালাল রিজিকের জন্য পরিশ্রম করাই উত্তম।
- আল্লাহর প্রতি নিবেদন: তিনি সবসময় নেক আমলের জন্য আগ্রহী ছিলেন — আমাদেরও তেমন হওয়া উচিত।
হজরত নূহ (আ.) – ধৈর্য, দাওয়াত ও তওক্কুলের নবী
পরিচয় ও দায়িত্ব
হজরত নূহ (আ.) ছিলেন আদম (আ.)-এর বহু প্রজন্ম পরের নবী। তিনি ছিলেন প্রথম রাসূল — অর্থাৎ এমন নবী যিনি একটি পুরো জাতিকে আল্লাহর পক্ষ থেকে দাওয়াত দিতে পাঠানো হয়েছেন।
কুরআনে বলা হয়েছে:
“আমি নূহকে তাঁর জাতির কাছে পাঠিয়েছিলাম।”
(সূরা নূহ: ১)
৯৫০ বছরের দাওয়াত
হজরত নূহ (আ.) দীর্ঘ ৯৫০ বছর আল্লাহর একত্ববাদ ও সত্য ধর্মের দাওয়াত দিয়ে গেছেন।
তিনি দিন-রাত, প্রকাশ্যে-গোপনে, একাকী-সমষ্টিগতভাবে বারবার মানুষকে বলতেন:
"তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো উপাস্য নেই।"
কিন্তু মানুষ তাঁকে উপহাস করত, তাঁকে ‘পাগল’ বলত, এমনকি তাঁকে মারতও।
নৌকা নির্মাণ ও প্রলয়
অবশেষে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ আসে:
"তুমি একটি নৌকা তৈরি করো, কারণ আমি তোমার জাতিকে ধ্বংস করব।"
তিনি আল্লাহর নির্দেশে বড় একটি নৌকা তৈরি করতে থাকেন। মানুষ তখনও তাঁকে উপহাস করে:
"তুমি মরুভূমিতে নৌকা বানাচ্ছো?"
তারপর একদিন শুরু হয় প্রলয়কারী প্লাবন।
আকাশ থেকে পানি বর্ষিত হতে থাকে, জমিন থেকেও পানি বেরিয়ে আসে।
হজরত নূহ (আ.) তাঁর অনুসারীদের ও কিছু প্রাণীকে জোড়ায় জোড়ায় নৌকায় উঠিয়ে নেন।
তাঁর নিজের ছেলে পর্যন্ত তাঁর কথা না শুনে প্লাবনে ডুবে যায়।
কুরআনের ভাষায়:
"সে বলল, আমি পাহাড়ে আশ্রয় নেব, যা আমাকে রক্ষা করবে।"
কিন্তু আল্লাহর আদেশে পাহাড়ও রক্ষা করতে পারেনি।
নতুন সূচনা
অবশেষে, পানি কমে যায় এবং নৌকা স্থির হয় ‘জুদি পাহাড়ে’। হজরত নূহ (আ.) ও তাঁর অনুসারীদের মাধ্যমে নতুনভাবে মানবজাতির জীবন শুরু হয়।
শিক্ষণীয় দিক:
- ধৈর্য: শত বছরের পরিশ্রমে খুব অল্প মানুষ তাঁর কথা শুনেছিল, কিন্তু তিনি হতাশ হননি।
- দায়িত্ব: নিজের ছেলেও তাঁর কথা না শুনলেও তিনি নিজের দাওয়াতের কাজ চালিয়ে গেছেন — নফসের চেয়ে সত্য বড়।
- আস্থা ও নির্ভরতা: আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা ও কর্মের মাধ্যমে বিজয় আসে।
হজরত হুদ (আ.) – অহংকারী জাতির সামনে সত্যের ডাক
পরিচয় ও প্রেরণ
হজরত হুদ (আ.) ছিলেন ‘আদ’ জাতির প্রতি প্রেরিত নবী। এই জাতি ছিল হজরত নূহ (আ.)-এর পরে পৃথিবীতে সবচেয়ে শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ এক জাতি। তারা ইয়েমেনের ‘আহকাফ’ নামক এলাকায় বাস করত।
আদ জাতি ছিল দৈহিক গঠন ও শক্তিতে অনেক বড় ও প্রভাবশালী। তারা বড় বড় অট্টালিকা ও স্তম্ভ নির্মাণে পারদর্শী ছিল। কিন্তু তারা ছিল তাওহিদ বিরোধী, মূর্তিপূজায় লিপ্ত, দম্ভে ভরপুর।
এই জাতির মধ্যেই হজরত হুদ (আ.) জন্মগ্রহণ করেন। আল্লাহ তাঁকে নবুয়ত দিয়ে আদ জাতির কাছে প্রেরণ করেন।
দাওয়াত ও প্রতিক্রিয়া
হজরত হুদ (আ.) বারবার নিজের জাতিকে সতর্ক করে বলেন—
"তোমরা শুধু আল্লাহর ইবাদত করো, তিনিই তোমার প্রতিপালক। তাঁর ছাড়া তোমার কোনো উপাস্য নেই।"
কিন্তু আদ জাতি হুদ (আ.)-কে মিথ্যাবাদী বলে অভিহিত করে। তারা বলে—
"তুমি তো আমাদের মতোই একজন মানুষ। আমরা তোমার কথায় চলবো না।"
তারা অহংকার করে নিজেদের শক্তি ও ঐশ্বর্যের গর্বে বলেন,
"আমাদের চেয়ে শক্তিশালী কে আছে?"
শাস্তির ঘোষণা ও ধ্বংস
হজরত হুদ (আ.) তাদেরকে আল্লাহর শাস্তির ভয় দেখান, কিন্তু তারা তা অবহেলা করে।
অবশেষে আল্লাহ তাআলা তাঁদের ওপর এক ভয়ঙ্কর ঝড় পাঠান — এমন এক প্রলয়কর বায়ু, যা সাত রাত ও আট দিন ধরে প্রবল গতিতে বইতে থাকে।
এই ঝড়ে পুরো আদ জাতি ধ্বংস হয়ে যায়।
তাদের দেহগুলো যেন উপড়ে ফেলা খেজুর গাছের গুঁড়ির মতো মাটিতে পড়ে ছিল।
শুধুমাত্র হুদ (আ.) ও তাঁর কিছু অনুসারী রক্ষা পান এবং আল্লাহর অনুগ্রহে নিরাপদ থাকেন।
শিক্ষণীয় দিক
- সত্য কথা বলার জন্য ভয় পাওয়া উচিত নয়, এমনকি সেটা ক্ষমতাবান জাতির সামনে হলেও।
- শক্তি ও ঐশ্বর্যে গর্ব করার ফলাফল ধ্বংস।
- নবীদের কাজ শুধু দাওয়াত দেওয়া, হেদায়েত দেওয়ার দায়িত্ব আল্লাহর।
- আল্লাহর উপর ভরসাকারীরা চূড়ান্ত রক্ষায় থাকেন, তা যতই বিপদ আসুক না কেন।
হজরত ছালিহ (আ.) – উষ্ট্রী, সতর্কবার্তা ও শাস্তির কাহিনী
পরিচয় ও জাতি
হজরত ছালিহ (আ.) ছিলেন ‘ছামূদ’ জাতির প্রতি প্রেরিত নবী। এ জাতি ছিল হজরত হুদ (আ.)-এর জাতি ‘আদ’-এর পরবর্তী। তারা আরব উপদ্বীপের হিজর নামক অঞ্চলে বাস করত। আজও সেখানে এই জাতির খোদাই করা পাথরের বাড়ির নিদর্শন দেখা যায় (আল-উলা, সৌদি আরব)।
ছামূদ জাতি ছিল দারুণ বুদ্ধিমান, কারিগরি ও শিল্পে পারদর্শী। তারা পাহাড় কেটে বাড়ি বানাতো, জমি চাষ করত, উন্নত সমাজ গঠন করেছিল। কিন্তু তারা ছিল মূর্তিপূজক এবং আল্লাহর অবাধ্য।
নবুয়ত ও দাওয়াত
আল্লাহ হজরত ছালিহ (আ.)-কে নবী বানিয়ে এই জাতির কাছে পাঠান। তিনি বললেন—
"হে আমার জাতি! তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো। তিনিই তোমার একমাত্র উপাস্য।"
তিনি তাদের আল্লাহর গুণাবলি স্মরণ করিয়ে দেন, কিন্তু তারা বলেন—
"তুমি তো আমাদেরই একজন। যদি সত্যিই নবী হও, তবে কোন নিদর্শন দেখাও।"
আল্লাহর নিদর্শন: উষ্ট্রী
তখন ছালিহ (আ.) দোয়া করেন, আল্লাহ তাদের জন্য এক অলৌকিক নিদর্শন পাঠান —
একটি বিশাল আকারের উষ্ট্রী পাথর ফেটে বের হয়ে আসে।
ছালিহ (আ.) বলেন—
"এটা আল্লাহর উষ্ট্রী। এটাকে আঘাত দিও না। এটি নির্দিষ্ট দিনে পানি খাবে, তোমরা অন্য দিনে। কেউ এর ক্ষতি করলে কঠিন শাস্তি আসবে।"
কিন্তু ছামূদ জাতি অহংকার ও অবাধ্যতায় পড়ে যায়। একদিন তারা উষ্ট্রীকে হত্যা করে।
ধ্বংস ও শাস্তি
ছালিহ (আ.) বললেন—
"তোমরা তিনদিন উপভোগ করো। তারপর তোমাদের ওপর শাস্তি আসবে।"
তিনদিন পর আকাশ থেকে এক বিকট শব্দ (সয়হাহ) ও ভয়ংকর ভূমিকম্পে পুরো জাতি ধ্বংস হয়ে যায়। যারা আল্লাহর নিদর্শনকে অবজ্ঞা করেছিল, তারা সবাই নিপাত হয়।
শুধু ছালিহ (আ.) ও তার অনুসারীরা রক্ষা পান।
শিক্ষণীয় দিক
- নবীদের নিদর্শনকে অবহেলা করা শাস্তির কারণ হতে পারে।
- অলৌকিক ঘটনা দেখে মুগ্ধ না হয়ে সত্য গ্রহণ করাই গুরুত্বপূর্ণ।
- অহংকার ও অবাধ্যতা যত বড় জাতিই হোক, ধ্বংস ডেকে আনে।
- সতর্কতা পাওয়ার পরও পরিবর্তন না আনলে ধ্বংস অনিবার্য হয়।
হজরত লুত (আ.) – অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও আল্লাহর শাস্তির নিদর্শন
পরিচয় ও প্রেরণ
হজরত লুত (আ.) ছিলেন হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর ভাইপো। তিনি ইব্রাহিম (আ.)-এর দাওয়াতের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। আল্লাহ তাঁকে সাদূম ও তার আশেপাশের শহরসমূহে নবী হিসেবে প্রেরণ করেন।
এই এলাকার জনগণ ছিল ভয়ানক অপরাধে লিপ্ত — তারা ছিল সমকামী, যা মানব ইতিহাসে আগে কখনো দেখা যায়নি। তারা অত্যন্ত বেহায়াপনা ও অশ্লীলতায় নিমজ্জিত ছিল।
দাওয়াত ও প্রতিরোধ
হজরত লুত (আ.) বারবার তাঁর জাতিকে সতর্ক করে বলেন:
"তোমরা এমন জঘন্য কাজ করছো যা তোমাদের পূর্বে কেউ করেনি। আল্লাহকে ভয় করো, এই পথ থেকে ফিরে এসো।"
কিন্তু তারা উপহাস করে এবং বলে—
"তুমি তো আমাদের ভালো কাজেও বাধা দাও! তোমার পরিবারসহ আমাদের শহর ছেড়ে চলে যাও।"
তারা এতটাই অধঃপতনে গিয়েছিল যে ফেরেশতারা মানুষরূপে এসে লুত (আ.)-এর বাড়িতে এলে তারা সেই পুরুষদের দিকেই লালসা নিয়ে ছুটে আসে।
ধ্বংস ও রক্ষা
এই অপরাধের কারণে আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে কঠোর শাস্তি। ফেরেশতারা লুত (আ.)-কে ও তাঁর অনুসারীদেরকে শহর থেকে বের করে আনেন।
এরপর পুরো শহরকে উল্টে দেওয়া হয় এবং ওপর থেকে পাথরের বৃষ্টি বর্ষণ করা হয়। শহর ধ্বংস হয়ে যায়, আর যারা সত্য গ্রহণ করেছিল, তারা রক্ষা পায়।
শিক্ষণীয় দিক
- সমাজ যত শক্তিশালী হোক, পাপাচার টিকতে পারে না।
- অন্যায়ের বিরুদ্ধে একা হলেও দাঁড়ানো উচিত — যেমন লুত (আ.) দাঁড়িয়েছিলেন।
- পরিবার থেকেও যদি কেউ সত্যের বিরোধিতা করে, তাকে অনুসরণ করা উচিত নয় (লুত (আ.)-এর স্ত্রী ধ্বংসপ্রাপ্তদের একজন ছিলেন)।
- আল্লাহর নির্দেশে জীবন রক্ষা হয়, তা যতই বিপদময় পরিস্থিতি হোক।
হজরত ইব্রাহিম (আ.) – তাওহিদের পথিক, ঈমানের পরীক্ষায় সফল
পরিচয় ও প্রেরণ
হজরত ইব্রাহিম (আ.) জন্মগ্রহণ করেন বাবেল (বর্তমান ইরাকের অন্তর্গত) অঞ্চলে। তাঁর পিতা আযর ছিলেন একজন বিখ্যাত মূর্তি প্রস্তুতকারী। কিন্তু ইব্রাহিম (আ.) ছোটবেলা থেকেই মূর্তিপূজার বিরোধিতা করেন এবং আল্লাহর একত্বে (তাওহিদে) বিশ্বাস স্থাপন করেন।
আল্লাহ তাঁকে নবুয়ত দান করেন এবং নির্দেশ দেন— তাঁর জাতিকে সত্যের দিকে ডাকো।
যুক্তিবাদ ও সাহসিকতা
ইব্রাহিম (আ.) তাঁর জাতিকে প্রশ্ন করেন—
"তোমরা যাদের পাথর, কাঠ বা ধাতব দিয়ে তৈরি করো, তাদের উপাসনা করো কেন? তারা তো নিজেদেরও রক্ষা করতে পারে না।"
তিনি যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করেন যে—
- সূর্য অস্ত যায়, তাই সে উপাস্য হতে পারে না
- চাঁদ, তারা — এরা ক্ষণস্থায়ী, তাই তারা উপাস্য হতে পারে না
তিনি বলেন—
"আমি একমাত্র সেই মহান সত্তার উপাসনা করি, যিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন।"
মূর্তি ভাঙা ও আগুনে নিক্ষেপ
একবার তাঁর জাতি উৎসবে গেলে তিনি সুযোগ নিয়ে মন্দিরের সব মূর্তি ভেঙে ফেলেন, শুধু সবচেয়ে বড়টি রেখে দেন।
লোকেরা ফিরে এসে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে— কে এটা করেছে?
ইব্রাহিম (আ.) কৌশলে বলেন— "সবচেয়ে বড় মূর্তিটাই হয়তো করেছে! ওকে জিজ্ঞেস করো!"
এতে তারা লজ্জিত হয়, কারণ জানে মূর্তিগুলো কথা বলতে পারে না। তবুও তারা ক্ষেপে গিয়ে ইব্রাহিম (আ.)-কে ভয়ানক আগুনে নিক্ষেপ করে।
কিন্তু আল্লাহ তাআলা আগুনকে আদেশ দেন—
"হে আগুন! তুমি ইব্রাহিমের জন্য ঠান্ডা ও নিরাপদ হয়ে যাও।"
হিজরত ও আল্লাহর পরীক্ষাসমূহ
ইব্রাহিম (আ.) এরপর ফিলিস্তিন, মিশর ও হিজাজ অঞ্চলে হিজরত করেন। তিনি দাওয়াতের কাজ চালিয়ে যান।
তাঁর জীবনে বহু কঠিন পরীক্ষা ছিল:
- বার্ধক্যে এসে তিনি পুত্র ইসমাঈল (আ.)-এর জন্ম লাভ করেন
- আল্লাহ নির্দেশ দেন— ছেলেকে কোরবানি করো। তিনি চোখ বন্ধ করে ছেলেকে কোরবানি করতে যান।
- আল্লাহ তাঁর পরীক্ষায় সন্তুষ্ট হয়ে কোরবানি স্থগিত করেন এবং একটি দুম্বা পাঠিয়ে দেন।
কাবা নির্মাণ
ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর পুত্র ইসমাঈল (আ.) আল্লাহর নির্দেশে পবিত্র কাবা ঘর নির্মাণ করেন।
তাঁরা দোয়া করেন—
"হে আল্লাহ! আমাদের এই কাজ কবুল করে নাও।"
শিক্ষণীয় দিক
- অন্ধ বিশ্বাস নয়, যুক্তিবাদ ও চিন্তার মাধ্যমে ঈমান গঠন করতে হয়।
- একজন মুসলমানকে সাহসিকতার সঙ্গে মূর্খতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়।
- ঈমানের পথে পরীক্ষা আসবেই — ত্যাগ ও আত্মসমর্পণ এর অংশ।
- ইব্রাহিম (আ.) প্রমাণ করেছেন, সত্যের পথে ধৈর্য ও ত্যাগে সফলতা আসে।
হজরত ইসমাঈল (আ.) – আত্মত্যাগ, কাবা নির্মাণ ও নবুয়তের ধারক
পরিচয়
হজরত ইসমাঈল (আ.) ছিলেন হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর প্রথম পুত্র। তাঁর মা হজরত হাজেরা (আ.) ছিলেন মিশরীয়। ইসমাঈল (আ.) জন্মগ্রহণ করেন ইব্রাহিম (আ.)-এর বার্ধক্যে — এটা ছিল আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ।
মরুতে বসবাস ও জমজম কূপ
আল্লাহর নির্দেশে ইব্রাহিম (আ.) তাঁর স্ত্রী হাজেরা (আ.) ও শিশু ইসমাঈল (আ.)-কে রেখে যান মক্কার মরুভূমিতে — যেখানে তখন কোনো পানি, গাছ বা জনমানব ছিল না।
হাজেরা (আ.) পানির খোঁজে পাহাড় সাফা ও মারওয়া-র মাঝে সাতবার ছোটাছুটি করেন।
এই সময়ে আল্লাহ জমিন থেকে এক চোখা পানির ঝরনা বের করে দেন — সেটাই হলো জমজম কূপ।
এই কূপের কারণে আশেপাশে লোকজন বসবাস শুরু করে, এবং সেখানে একটি জনপদ গড়ে ওঠে।
কোরবানি পরীক্ষায় আত্মসমর্পণ
একদিন ইব্রাহিম (আ.) স্বপ্নে দেখেন যে, তাঁকে ইসমাঈল (আ.)-কে কোরবানি করতে বলা হচ্ছে। তিনি বুঝলেন এটি আল্লাহর আদেশ।
তিনি ছেলেকে বলেন—
"হে ইসমাঈল! আমি স্বপ্নে দেখি, তোমাকে কোরবানি করছি। তুমি কী মনে কর?"
ইসমাঈল (আ.) বিনা দ্বিধায় বলেন—
"হে আমার পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তা করুন। ইনশাআল্লাহ, আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন।"
কিন্তু কোরবানি সম্পন্ন হওয়ার আগেই আল্লাহ ফেরেশতা পাঠিয়ে কোরবানি বন্ধ করেন এবং একটি দুম্বা দেন — এই ঘটনার স্মরণেই আজ আমরা ঈদুল আযহা পালন করি।
কাবা নির্মাণ
ইসমাঈল (আ.) ও তাঁর পিতা ইব্রাহিম (আ.) মিলে কাবা ঘর পুনর্নির্মাণ করেন। তাঁরা কাবার ভিত্তি স্থাপন করেন এবং দোয়া করেন—
"হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের কাছ থেকে এটি কবুল করো।"
এই কাবা পরবর্তীতে মুসলমানদের কিবলা হিসেবে নির্ধারিত হয়।
নবুয়ত ও দাওয়াত
ইসমাঈল (আ.) বড় হয়ে মক্কা অঞ্চলে নবী নিযুক্ত হন। তিনি আমালিক ও জুরহুম গোত্রকে দাওয়াত দেন। তিনি সততা, দায়িত্ববোধ ও বিনয়ী আচরণের জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন।
শিক্ষণীয় দিক
- সন্তানের উচিত পিতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, বিশেষত যখন সে আল্লাহর পথে আহ্বান করে।
- ইসমাঈল (আ.) আমাদের শেখান, আত্মত্যাগ ও আত্মসমর্পণ ঈমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
- কোরবানির আসল শিক্ষা হলো আল্লাহর আদেশে নিজের ইচ্ছাকে ত্যাগ করা।
- নবীগণের জীবন ছিল পরিপূর্ণ আনুগত্য ও দায়িত্ববোধে গঠিত।
হজরত ইসহাক (আ.) – প্রতিশ্রুতি পূরণ, বরকতময় বংশ ও শান্তিপূর্ণ নবুয়ত
পরিচয়
হজরত ইসহাক (আ.) ছিলেন হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর দ্বিতীয় পুত্র এবং তাঁর স্ত্রী সারা (আ.)-এর সন্তান। ইব্রাহিম (আ.) ও সারা (আ.) দীর্ঘদিন নিঃসন্তান ছিলেন। বৃদ্ধ বয়সে আল্লাহ তাআলা তাদের সুসংবাদ দেন— এক জ্ঞানী ও সৎ পুত্র জন্মাবে।
তিনি জন্মগ্রহণ করেন ফিলিস্তিনে।
অলৌকিক জন্ম
ইসহাক (আ.)-এর জন্ম ছিল এক অলৌকিক ঘটনা। কারণ তাঁর পিতা ও মাতা তখন অত্যন্ত বৃদ্ধ ছিলেন। ফেরেশতারা যখন ইব্রাহিম (আ.)-এর কাছে এসে সারা (আ.)-কে ইসহাক (আ.)-এর সুসংবাদ দেন, তখন তিনি বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন—
"আমি কি বৃদ্ধ অবস্থায় সন্তান জন্ম দেব?!"
ফেরেশতারা বলেন—
"এটাই তো তোমার প্রভুর আদেশ। তিনি যা চান তা করেন।"
শান্তিপূর্ণ নবুয়ত
ইসহাক (আ.) একজন শান্তিপূর্ণ নবী ছিলেন। তিনি বিশেষ কোনো যুদ্ধ বা বিরোধের সাথে জড়িত ছিলেন না। বরং তিনি তাওহিদ প্রচারে মনোনিবেশ করেন এবং মানুষকে সত্য পথে ডাকেন।
তাঁর দাওয়াত ছিল ইব্রাহিম (আ.)-এর দাওয়াতের ধারাবাহিকতা।
পরিবার ও বংশধারা
ইসহাক (আ.)-এর পুত্র হলেন ইয়াকুব (আ.)। তাঁর মাধ্যমেই বনি ইসরাঈল বংশের সূচনা হয়, যেখানে পরবর্তীতে মূসা (আ.), হারূন (আ.), দাঊদ (আ.), সুলায়মান (আ.), ইয়াহইয়া (আ.), ঈসা (আ.) প্রমুখ নবী আসেন।
আল্লাহর প্রশংসা ও দোয়া
আল্লাহ কুরআনে ইব্রাহিম (আ.)-এর দোয়া উল্লেখ করেছেন—
"প্রশংসা আল্লাহর, যিনি বার্ধক্যে আমাকে ইসমাঈল ও ইসহাক দান করেছেন।"
(সূরা ইব্রাহিম: ৩৯)
শিক্ষণীয় দিক
- আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রার্থনা গ্রহণ করেন, এমনকি অসম্ভব মনে হলেও।
- ইসহাক (আ.) আমাদের শিখান— শান্তিপূর্ণভাবে সত্যের দাওয়াত চালিয়ে যাওয়া মহান কাজ।
- ঈমানদার পরিবার ও সঠিক দিকনির্দেশনার মধ্যে বেড়ে ওঠা একজন মানুষকে নবুয়তের উচ্চতায় পৌঁছে দিতে পারে।
হজরত ইয়াকুব (আ.) – ধৈর্যের দৃষ্টান্ত ও নবীগণের পিতা
পরিচয়
হজরত ইয়াকুব (আ.) ছিলেন হজরত ইসহাক (আ.)-এর পুত্র এবং হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর পৌত্র। তিনি ছিলেন এক সৎ, ধার্মিক ও তাওহিদবাদী নবী। আল্লাহ তাঁকে নবুয়তের দায়িত্ব দেন এবং তাঁর বংশ থেকেই সৃষ্টি হয় বনি ইসরাঈল জাতি — তাই তাঁকে “ইসরাঈল” বলা হয়।
পরিবার ও সন্তান
হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর ১২ জন পুত্র ছিল, যাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন হজরত ইউসুফ (আ.)। তাঁর পুত্ররা পরবর্তীতে বনি ইসরাঈল গোত্রের ভিত্তি স্থাপন করে।
ইউসুফ (আ.) ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতেন — একদিন তিনি মহান কিছু হবেন। ইয়াকুব (আ.) বুঝতেন যে এই সন্তান বিশেষ গুণসম্পন্ন।
ইউসুফ (আ.)-কে হারানো ও ধৈর্য
ইয়াকুব (আ.)-এর জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় আসে, যখন তাঁর কিছু পুত্র ষড়যন্ত্র করে ইউসুফ (আ.)-কে কূপে ফেলে দেয় এবং মিথ্যা বলে যে—
“এক নেকড়ে ওকে খেয়ে ফেলেছে।”
ইয়াকুব (আ.) এই দুঃখে অন্ধ হয়ে যান। কিন্তু তিনি কখনো আল্লাহর প্রতি অভিযোগ করেননি। তিনি শুধু বলতেন—
"সবরই আমার কাজ, আর আমি আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাই।"
পুনর্মিলন ও প্রাপ্তি
বহু বছর পর যখন ইউসুফ (আ.) মিশরের রাজপ্রাসাদে উঠে যান, তখন তিনি তাঁর পিতা ও পরিবারকে ডেকে পাঠান।
ইয়াকুব (আ.) ও তাঁর পরিবার মিশরে এসে পুনরায় মিলিত হন। সেই সময় তিনি আবার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পান। এই মিলনের সময় ইউসুফ (আ.) মাথা নত করেন পিতার সামনে — এটি ছিল ভালোবাসা ও সম্মানের প্রতীক।
মৃত্যু ও দোয়া
ইয়াকুব (আ.) মৃত্যুর আগে তাঁর সন্তানদের উদ্দেশে বলেন—
“তোমরা আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস রেখো। তিনি তোমাদের একমাত্র রব।”
তিনি দোয়া করেন, যেন তাঁকে ইব্রাহিম (আ.), ইসহাক (আ.)-এর সাথেই যুক্ত করে নেয়া হয়।
শিক্ষণীয় দিক
- পুত্র হারিয়েও ধৈর্য হারাননি — এটা ছিল প্রকৃত ঈমানদারের পরিচয়।
- একজন পিতা তাঁর সন্তানদের ঈমানের দিক থেকে সচেতনভাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন — এটা ইয়াকুব (আ.)-এর শিক্ষা।
- তিনি প্রমাণ করেছেন, কঠিন সময়েও আল্লাহর প্রতি আস্থা হারানো উচিত নয়।
- দুঃখ যত দীর্ঘই হোক, আল্লাহ সবকিছুর উত্তম পরিণতি দিয়ে থাকেন।
হজরত ইউসুফ (আ.) – স্বপ্ন, ষড়যন্ত্র, কারাগার, ক্ষমা ও শাসনের এক বিস্ময়কর যাত্রা
পরিচয়
হজরত ইউসুফ (আ.) ছিলেন হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর পুত্র ও হজরত ইসহাক (আ.)-এর পৌত্র। তাঁর মায়ের নাম ছিল রাহিল। তিনি ছিলেন নবী পরিবারে জন্ম নেওয়া এক সুন্দর চরিত্রের মানুষ, যিনি অসাধারণ রূপ, চরিত্র এবং ধৈর্যের জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন।
শৈশব ও স্বপ্ন
একদিন ছোট্ট ইউসুফ (আ.) তাঁর পিতাকে বললেন—
"আব্বা! আমি স্বপ্নে দেখলাম সূর্য, চাঁদ এবং এগারোটি তারা আমাকে সেজদা করছে।"
তাঁর পিতা বললেন—
"এই স্বপ্ন তোমার বড় ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়। তবে ভাইদের কাছে বলো না, তারা হিংসা করতে পারে।"
ভাইদের ষড়যন্ত্র
ইউসুফ (আ.)-এর অসাধারণ গুণ ও বাবার ভালোবাসার কারণে তাঁর ভাইরা ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ে। একদিন তারা বাবার কাছ থেকে ইউসুফ (আ.)-কে বেড়াতে নিয়ে যায় এবং তাঁকে একটি কূপে ফেলে দেয়।
বাড়ি ফিরে তারা বলল, "নেকড়ে তাঁকে খেয়ে ফেলেছে।"
কিন্তু আল্লাহ ইউসুফ (আ.)-কে রক্ষা করেন। কিছু পথিক এসে তাঁকে কূপ থেকে তুলে মিশরে এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দেয়।
মিশরে নতুন জীবন ও এক কঠিন পরীক্ষা
মিশরের শাসকের (আযিজ) স্ত্রী ইউসুফ (আ.)-এর প্রতি মোহিত হয়ে তাকে পাপের আহ্বান করেন। কিন্তু ইউসুফ (আ.) বলেন—
"আল্লাহর আশ্রয়! তিনি আমার রব, যিনি আমার জন্য ভালো পরিবেশ তৈরি করেছেন। আমি কখনোই সীমালঙ্ঘনকারীদের মধ্যে হব না।"
এই অপরাধ তিনি না করেও, শেষ পর্যন্ত তিনি কারাগারে পাঠানো হন।
কারাগারে দাওয়াত ও ব্যাখ্যার গুণ
জেলখানায় থাকা অবস্থায় ইউসুফ (আ.) স্বপ্ন ব্যাখ্যার মাধ্যমে খ্যাতি অর্জন করেন। একদিন রাজা একটি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেন এবং ইউসুফ (আ.)-কেই ডেকে পাঠান।
তিনি বলেন:
"আপনার সাতটি মোটা গরু এবং সাতটি শুকনা গরুর স্বপ্নের মানে হলো — সাত বছর ভালো ফসল হবে, এরপর সাত বছর দুর্ভিক্ষ আসবে।"
রাজা ইউসুফ (আ.)-এর জ্ঞান, সততা ও প্রজ্ঞায় মুগ্ধ হন এবং তাঁকে মিশরের খাদ্যভান্ডারের দায়িত্ব দেন।
ভাইদের সাথে পুনর্মিলন
দুর্ভিক্ষে পড়ে ইয়াকুব (আ.)-এর পরিবার মিশরে খাদ্য নিতে আসে। ইউসুফ (আ.) তখন তাদের চিনে ফেলেন কিন্তু তাঁর পরিচয় গোপন রাখেন।
পরবর্তীতে তিনি নিজ পরিচয় প্রকাশ করেন এবং বলেন—
"আজ তোমাদের কোনো দোষারোপ নেই। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন।"
এইভাবেই একজন ভাই, যিনি কূপে ফেলে দেওয়া হয়েছিলেন, পরিণামে ভাইদের রক্ষা করেন এবং ক্ষমা করে দেন।
পিতা-মাতার আগমন ও সেজদা
ইউসুফ (আ.) তাঁর পিতা-মাতাকে মিশরে নিয়ে আসেন। তখন সবাই সম্মানে তাঁর সামনে নত হয়। এটাই ছিল তাঁর শৈশবের স্বপ্নের বাস্তবতা।
মৃত্যুর সময় প্রার্থনা
ইউসুফ (আ.) দোয়া করেন:
"হে আমার প্রভু! তুমি আমাকে রাজ্য দান করেছো এবং স্বপ্ন ব্যাখ্যার জ্ঞান দিয়েছো। তুমি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর স্রষ্টা, তুমি দুনিয়া ও আখিরাতে আমার অভিভাবক। আমাকে মুসলিম অবস্থায় মৃত্যু দাও এবং সৎ লোকদের সাথে শামিল করো।"
(সূরা ইউসুফ: ১০১)
শিক্ষণীয় দিক
- কঠিন সময়েও ধৈর্য ও সততা বজায় রাখলে আল্লাহ উত্তম পরিণতি দেন।
- ক্ষমা ও দয়া একজন নবীর প্রধান গুণ।
- আল্লাহর পরিকল্পনা সব ষড়যন্ত্রকে পরাজিত করে।
- জীবনরথে উত্থান-পতন থাকবেই, কিন্তু ঈমান থাকলে পরিণাম শুভ হয়।
হজরত আইয়ুব (আ.) – ধৈর্য, পরীক্ষার আগুনে পুড়ে আরও উজ্জ্বল হওয়া
পরিচয়
হজরত আইয়ুব (আ.) ছিলেন একজন নবী, যিনি আল্লাহর বিশাল নিয়ামত, সম্পদ ও পরিবারে পরিপূর্ণ জীবন যাপন করতেন। তিনি ছিলেন ইসহাক (আ.)-এর বংশধর এবং ইয়াকুব (আ.)-এর বংশীয় আত্মীয়।
তিনি ছিলেন ধনী, সম্মানিত এবং আল্লাহভীরু। তাঁর বহু সন্তান ও বিশাল সম্পত্তি ছিল।
আল্লাহর কঠিন পরীক্ষা শুরু
আল্লাহ তাঁর বান্দাদের পরীক্ষা করেন — তা সফলভাবে উত্তীর্ণ হলে তাদের মর্যাদা আরও বাড়িয়ে দেন। হজরত আইয়ুব (আ.)-এর জীবনেও নেমে আসে একের পর এক বিপর্যয়:
- তাঁর সকল সম্পদ হারিয়ে যায়।
- একে একে তাঁর সন্তানরা মারা যায়।
- তিনি কঠিন চর্মরোগে আক্রান্ত হন, যা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে মানুষ তাঁর কাছ থেকে দূরে সরে যায়।
- সমাজের মানুষ তাঁকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়, এমনকি নিজের শহর থেকেও বের করে দেয়।
কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও আইয়ুব (আ.) কখনো বলেননি, “আল্লাহ, তুমি কেন আমাকে এই কষ্ট দিচ্ছো?” বরং তিনি বলতেন:
"আমি অসুস্থ হয়েছি, আর তুমি তো সর্বদয়।"
(সূরা আন্বিয়া: ৮৩)
স্ত্রীর ধৈর্য ও সহচরিতা
তাঁর স্ত্রী ছিলেন সত্যিকারের সহধর্মিণী। তিনি আইয়ুব (আ.)-কে কখনো ছেড়ে যাননি। কাজ করে, ভিক্ষা করে কিংবা ঘরের কাজ করে স্বামীর জন্য খাদ্য জোগাড় করতেন। তাঁকে বারবার বলা হতো, “তোমার স্বামী অভিশপ্ত”— কিন্তু তিনি কখনো বিশ্বাস হারাননি।
আল্লাহর দয়া ও আরোগ্য
অবশেষে, আইয়ুব (আ.) আল্লাহর দরবারে দোয়া করেন:
"হে আমার প্রভু! শয়তান আমাকে কষ্ট ও যন্ত্রণায় ফেলেছে।"
আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করেন এবং বলেন:
"তোমার পা দিয়ে ভূমি আঘাত করো। এটি এমন পানি— যা দিয়ে গোসল করলে রোগ দূর হবে, পান করলে অভ্যন্তরের অসুখও যাবে।"
(সূরা সাদ: ৪২)
তিনি সুস্থ হয়ে যান, এবং আল্লাহ তাঁকে তাঁর হারানো সন্তানদের পুনরায় দান করেন — এমনকি আগের চেয়ে অধিক সম্পদ ও পরিবার লাভ করেন।
শিক্ষণীয় দিক
- ধৈর্যই প্রকৃত ঈমানের পরিচয়।
- বিপদে পড়ে হাল না ছাড়া, বরং দোয়া ও বিশ্বাসে স্থির থাকা — এটিই আল্লাহর কাছে প্রিয়।
- আল্লাহ কখনো তাঁর বান্দাকে দীর্ঘদিন কষ্ট দিয়ে রাখেন না, তিনি সবসময় পরীক্ষা শেষে পুরস্কার দেন।
হজরত শুয়াইব (আ.) – সততার আহ্বানকারী ও মাদইয়ান জাতির নবী
পরিচয়
হজরত শুয়াইব (আ.) ছিলেন মাদইয়ান ও আইকা নামক দুটি জাতির দিকে পাঠানো নবী। অনেকে বলেন, তিনি ছিলেন হজরত লুত (আ.)-এর বংশধর। আল্লাহ তাঁকে নবুয়ত দিয়ে প্রেরণ করেন এমন এক জাতির কাছে, যারা ছিল—
- মাপে কম দিত,
- ওজনে কম করত,
- অন্যদের সম্পদ অন্যায়ভাবে দখল করত,
- এবং খোলা রাস্তায় ডাকাতি করত।
শুয়াইব (আ.)-এর দাওয়াত
তিনি তাঁদের বললেন—
"হে আমার জাতি! আল্লাহর বান্দেগি করো। মাপে ও ওজনে সম্পূর্ণ দাও, মানুষের জিনিস কম দিও না। পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না। আমি তোমাদের জন্য মঙ্গল কামনা করি।"
(সূরা হুদ: ৮৫-৮۶)
তিনি বোঝাতে চাইলেন যে সত্যিকারের ঈমান শুধু নামাজ-রোজা নয় — বরং ব্যবসা-বাণিজ্যেও সৎ থাকা জরুরি।
জাতির অবাধ্যতা ও বিদ্রূপ
তাঁর জাতি বলল—
"হে শুয়াইব! তোমার নামাজ কি তোমাকে শেখায় যে, আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদের উপাস্যদের ছেড়ে দিই, কিংবা আমাদের সম্পদের ব্যাপারে নিজের মতো ব্যবহার না করি?"
তারা তাঁকে ভয় দেখাতে লাগল, বিদ্রূপ করতে লাগল এবং বলল—
"তুমি না থাকলে, তোমাকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করতাম।"
শুয়াইব (আ.)-এর সতর্কবার্তা
তিনি ধৈর্য ধরে বারবার বললেন—
"আমি শুধু আল্লাহর আদেশ পালন করছি। তোমরা যদি এখন না ফেরো, তাহলে একদিন আফসোস করবে।"
আল্লাহর শাস্তি
যখন তারা সব সতর্কতা অস্বীকার করল, তখন আল্লাহ তাদের উপর প্রেরণ করলেন:
- তীব্র ভূমিকম্প,
- জোরালো চিৎকারের শব্দ (সাইহা),
- এবং ঘন অন্ধকার ছায়া যা ধ্বংস বয়ে আনে।
এইভাবে এক মুহূর্তেই একটি সমৃদ্ধ জাতি ধ্বংস হয়ে যায়।
শুয়াইব (আ.) তখন বললেন—
"হে আমার জাতি! আমি তোমাদের সতর্ক করেছিলাম। আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি।"
শিক্ষণীয় দিক
- সততা ও ন্যায়বিচার একজন ঈমানদারের প্রধান গুণ।
- দুনিয়ার ব্যবসা ও সম্পদ যদি অন্যায়ভাবে লাভ হয়, তা ধ্বংস ডেকে আনে।
- একজন নবী কেবল ধর্মীয় ইবাদতের দাওয়াত দেন না, বরং নৈতিকতা, সমাজনীতি ও অর্থনীতির সঠিক পথও শেখান।
- অবিশ্বাস আর অহংকার আল্লাহর শাস্তিকে অনিবার্য করে তোলে।
হজরত মূসা (আ.) – মুক্তির বার্তা ও নবুয়তের মহান সংগ্রাম
জন্ম ও শৈশব
হজরত মূসা (আ.) জন্ম নেন বনী ইসরাইল জাতিতে, যারা ফেরাউন ও তার শাসনব্যবস্থার অধীনে কঠোর নিপীড়নের শিকার ছিল।
ফেরাউন এক ভয়ংকর আদেশ দেয়—
"বনী ইসরাইলদের নবজাতক ছেলে শিশুদের হত্যা করো, মেয়েদের বাঁচিয়ে রাখো!"
তখন আল্লাহ মূসা (আ.)-এর মায়ের অন্তরে এক নির্দেশ দেন—
"তুমি তোমার শিশুকে দুধ পান করাও, আর যদি ভয় পাও, তাহলে তাকে একটি কাষ্ঠের পাত্রে রেখে নদীতে ভাসিয়ে দাও।"
(সূরা কাসাস: ৭)
অলৌকিকভাবে সেই শিশু ফেরাউনের রাজপ্রাসাদে পৌঁছে যায় এবং ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়া শিশুটিকে দত্তক নেন।
যৌবন ও হত্যাকাণ্ড
যৌবনে মূসা (আ.) একদিন দেখেন এক মিশরীয় ব্যক্তি এক ইসরাইলীয়কে মারছে। মূসা (আ.) রাগে একজনকে ঘুষি মারলে সে মারা যায়। এর ফলে তিনি মিশর ত্যাগ করে মাদইয়ানে পালিয়ে যান।
নবুয়তপ্রাপ্তি
মাদইয়ানে তিনি শুয়াইব (আ.)-এর কন্যাকে বিবাহ করেন এবং বেশ কিছু বছর কাটান। এরপর ফেরার পথে তূর পাহাড়ে আগুনের আলো দেখতে পান।
সেখানে আল্লাহ তাঁকে ডাক দেন:
"হে মূসা! আমি আল্লাহ, তোমার প্রভু।"
সেইখানেই তিনি নবুয়ত লাভ করেন এবং ফেরাউনের কাছে পাঠানো হয় দাওয়াত দিতে।
ফেরাউনের দরবারে
মূসা (আ.) তাঁর ভাই হারুন (আ.)-কে সহকারি নবী হিসেবে নিয়ে ফেরাউনের দরবারে বলেন:
"তোমরা আল্লাহর বান্দাদের মুক্ত করো এবং আল্লাহর দিকে ফিরো।"
ফেরাউন অহংকার করে এবং বলে—
"আমি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই!"
মূসা (আ.) আল্লাহর পক্ষ থেকে লাঠিকে সাপে পরিণত করা এবং হাতের মাধ্যমে আলোক বিচ্ছুরণ প্রমাণ দেখান।
জাদুকরদের ঈমান আনা
ফেরাউন তাঁর জাদুকরদের ডেকে চ্যালেঞ্জ দেন। কিন্তু মূসা (আ.) যখন লাঠি নিক্ষেপ করে সাপে পরিণত করেন, তখন জাদুকররা বুঝে যায়—
"এটি জাদু নয়, এটি সত্য।"
তারা সেজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং বলে:
"আমরা হারুন ও মূসার প্রভুর প্রতি ঈমান আনলাম।"
ফেরাউন ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের হত্যা করে।
বনী ইসরাইলের মুক্তি
ফেরাউনের নির্যাতন যখন চরমে ওঠে, তখন আল্লাহ মূসা (আ.)-কে নির্দেশ দেন:
"রাতের বেলা আমার বান্দাদের নিয়ে বেরিয়ে পড়ো।"
তারা যখন সমুদ্রের কিনারে পৌঁছায়, পেছন থেকে ফেরাউন বাহিনী ধেয়ে আসে। তখন মূসা (আ.) বলেন:
"আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন।"
আল্লাহ সমুদ্রকে দ্বিখণ্ডিত করেন — পানির মাঝে রাস্তা সৃষ্টি হয়, আর বনী ইসরাইল নিরাপদে পার হয়ে যায়।
ফেরাউন ও তার সৈন্যরা সেই পথে প্রবেশ করলে, সমুদ্র আবার একত্র হয়ে যায় এবং তারা ডুবে যায়।
ওহি ও কিতাব
মূসা (আ.) তূর পাহাড়ে যান, যেখানে তিনি তাওরাত (ঈশ্বরপ্রদত্ত কিতাব) লাভ করেন। এই কিতাবে ইহুদি ধর্মের মৌলিক নীতিমালা ছিল।
বনী ইসরাইলের অবাধ্যতা
মুক্তির পরও বনী ইসরাইল নানা অবাধ্যতা প্রদর্শন করে:
- তারা গরু উপাসনা করে (বাছুরের প্রতিমা),
- বারবার মূসা (আ.)-কে কষ্ট দেয়,
- আল্লাহর নির্দেশ মানতে অবহেলা করে।
শিক্ষণীয় দিক
- দাসত্বের মধ্যে থেকেও আল্লাহর সাহায্যে জাতি মুক্তি পেতে পারে।
- সত্য ও ধৈর্য নিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোই নবুয়তের প্রধান শিক্ষা।
- অলৌকিকতা দেখলেও যে বিশ্বাস করে না, তাকে আল্লাহ হেদায়েত দেন না।
- ইমান আনার পরে অবাধ্যতা ধ্বংস ডেকে আনে।
হজরত হারুন (আ.) – সহনশীল নেতা ও সত্যের সহযোগী
পরিচয়
হজরত হারুন (আ.) ছিলেন হজরত মূসা (আ.)-এর বড় ভাই। তাঁকে আল্লাহ নবী হিসেবে মনোনীত করেন মূসা (আ.)-এর সহযোগী হিসেবে, যেন তারা ফেরাউনের সামনে একসাথে দাঁড়াতে পারেন।
মূসা (আ.) আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন:
"হে আমার প্রভু! আমার ভাই হারুনকে আমার সহযোগী করো।"
(সূরা ত্বা-হা: ২৯-৩২)
আল্লাহ তাঁর প্রার্থনা কবুল করেন।
বিশেষ গুণাবলি
হারুন (আ.)-এর কণ্ঠ ছিল সুন্দর ও প্রভাবশালী। তিনি ছিলেন—
- বক্তৃতায় পারদর্শী,
- সহনশীল ও নরম স্বভাবের,
- এবং জাতিকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে সঠিক পথে রাখার চেষ্টায় মনোযোগী।
মিশনে অংশগ্রহণ
হারুন (আ.)-এর ভূমিকা ছিল:
- মূসা (আ.)-এর সাথে ফেরাউনের দরবারে আল্লাহর বার্তা পৌঁছে দেওয়া,
- বনী ইসরাইল জাতিকে সত্য ও ইবাদতের দিকে আহ্বান করা,
- এবং মূসা (আ.) যখন তূর পাহাড়ে ওহি গ্রহণে যান, তখন তাঁর অনুপস্থিতিতে জাতির দায়িত্ব পালন করা।
গরু পূজার ঘটনা
মূসা (আ.) তূর পাহাড়ে গেলে, তাঁর অনুপস্থিতিতে কিছু লোক একটি সোনার গরুর মূর্তি তৈরি করে, এবং তা পূজা করতে থাকে।
হারুন (আ.) জাতিকে বারবার সতর্ক করেন—
"হে আমার জাতি! এ তো এক ফিতনা। তোমাদের আসল রব হচ্ছেন আল্লাহ, তাই আমার অনুসরণ করো এবং মূসার আদেশ মান্য করো।"
(সূরা ত্বা-হা: ৯০)
কিন্তু অনেকেই তাঁর কথা মানেনি।
মূসা (আ.)-এর প্রতিক্রিয়া
যখন মূসা (আ.) ফিরে এসে এসব দেখলেন, তখন তিনি দুঃখ, রাগ ও হতাশায় হারুন (আ.)-এর দাড়ি ধরে টেনে ধরেন।
হারুন (আ.) বলেন—
"হে আমার ভাই! আমার দাড়ি ও মাথা ধরে টেনো না। আমি তোমার জাতিকে বিভক্ত হতে দিতে চাইনি।"
মূসা (আ.) তখন বুঝলেন, তাঁর ভাই আসলে পরিস্থিতি সামলাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন।
শিক্ষণীয় দিক
- নেতৃত্ব মানে শুধু আদেশ নয় — সহনশীলতা ও পরামর্শমূলক আচরণও প্রয়োজন।
- সঠিক পথ দেখাতে হলে নম্রতা ও বুদ্ধিমত্তা থাকা জরুরি।
- সত্যের সহযোগী ও সহচর থাকা একজন নেতার জন্য বড় শক্তি।
- ঈমানদারদের মাঝে ভুল হলে, সহানুভূতিশীলভাবে সংশোধন করাই ইসলামি নেতৃত্বের আদর্শ।
হজরত যাকারিয়া (আ.) – দোয়ার শক্তি ও আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন
পরিচয়
হজরত যাকারিয়া (আ.) ছিলেন ইসরাইলি বংশোদ্ভূত একজন নবী, যিনি আল্লাহর ঘনিষ্ঠ বান্দা ছিলেন। তিনি ছিলেন মরিয়ম (আ.)-এর অভিভাবক এবং বায়তুল মুকাদ্দাস-এর খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন।
তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল ইলিশাবা (অনেকে বলেন), এবং উভয়েই ছিলেন খুব বৃদ্ধ ও নির্বংশ — তাঁদের কোন সন্তান ছিল না।
মরিয়মের ঘটনা থেকে শিক্ষা
যাকারিয়া (আ.) ছিলেন হজরত মরিয়ম (আ.)-এর অভিভাবক। তিনি একদিন মরিয়মের কাছে খাবার দেখে বিস্মিত হয়ে বলেন:
"হে মরিয়ম! এটা কোথা থেকে এলে?"
মরিয়ম উত্তর দিলেন:
"এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে; তিনি যাকে ইচ্ছা দেন অগণিত রিজিক।"
এই দৃশ্য দেখে তাঁর হৃদয়ে সন্তান লাভের আশা জাগে, যদিও বয়স অনেক বেশি।
সন্তানের জন্য দোয়া
তিনি তখন আল্লাহর কাছে একান্তভাবে দোয়া করেন:
"হে আমার প্রভু! আমাকে আপনার পক্ষ থেকে এক সৎ সন্তান দিন। আপনি প্রার্থনা শুনেন।"
(সূরা আলে ইমরান: ৩৮)
আল্লাহ তখন ফেরেশতা পাঠিয়ে বলেন:
"হে যাকারিয়া! আমরা তোমাকে এক পুত্রের সুসংবাদ দিচ্ছি, তাঁর নাম হবে ইয়াহইয়া।"
অলৌকিকতা
এই সন্তানের আগমনের মধ্যেও ছিল অলৌকিকতা:
- যাকারিয়া (আ.) ছিলেন অত্যন্ত বৃদ্ধ।
- তাঁর স্ত্রী ছিলেন বন্ধ্যা।
- তবু আল্লাহ বললেন:
"এটাই আমার কুদরতের নিদর্শন।"
আল্লাহর কুদরতের প্রতি ভরসা
যাকারিয়া (আ.) বিস্ময় প্রকাশ করেন—
"আমার কীভাবে সন্তান হবে?"
আল্লাহ বলেন—
"তোমার প্রভু বলেন: এটা আমার জন্য সহজ।"
(সূরা মরিয়ম: ৯)
নিদর্শন ও নিশ্চুপতা
আল্লাহ যাকারিয়া (আ.)-কে বলেন:
"তোমার নিদর্শন এই যে, তুমি তিন দিন কাউকে মুখে কথা বলবে না, তবে ইশারায় কথা বলতে পারবে।"
তিনি এই সময় আল্লাহর তাসবিহে লিপ্ত থাকেন এবং আল্লাহর স্মরণে আত্মনিয়োগ করেন।
শিক্ষণীয় দিক
- আল্লাহর কাছে কিছুই অসম্ভব নয় — বয়স, দাম্পত্য সমস্যা কিছুই তাঁর কুদরতের সীমাবদ্ধতা নয়।
- দোয়া ও নির্ভরতা মানুষের জীবনে অলৌকিক পরিবর্তন আনতে পারে।
- ইবাদত, দোয়া, ধৈর্য ও তাওয়াক্কুল একজন মুমিনের প্রধান অস্ত্র।
- আল্লাহ যখন দেন, তা হয় একেবারে অনুপম ও পূর্ণ রকমে।
হজরত ইয়াহইয়া (আ.) – পবিত্রতা, সত্যবাদিতা ও শহীদির প্রতীক
অলৌকিক জন্ম
ইয়াহইয়া (আ.)-এর জন্ম এক অলৌকিক ঘটনার মাধ্যমে হয়।
তাঁর পিতা হজরত যাকারিয়া (আ.) ছিলেন বৃদ্ধ, আর মা ছিলেন বন্ধ্যা।
তবু আল্লাহ বলেন:
"হে যাকারিয়া! আমি তোমাকে ইয়াহইয়া নামে একটি সন্তানের সুসংবাদ দিচ্ছি।"
(সূরা মরিয়ম: ৭)
এ নাম আগে কখনো কাউকে দেওয়া হয়নি।
শৈশবেই নবুয়ত
আল্লাহ তাঁকে শৈশবেই নবুয়তের মর্যাদা দেন:
"হে ইয়াহইয়া! তুমি কিতাব (তাওরাত) দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করো।"
(সূরা মরিয়ম: ১২)
তাঁকে দেয়া হয়:
- হিকমা (জ্ঞান),
- নرم হৃদয়,
- এবং বিশুদ্ধ চরিত্র।
চরিত্র ও গুণাবলি
- তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক ও আল্লাহভীরু।
- নারীসঙ্গ থেকে দূরে থাকতেন, সম্পূর্ণ পবিত্র জীবনযাপন করতেন।
- ছিলেন সত্যবাদী ও ন্যায়পরায়ণ।
- মানুষের কাছে তাওরাতের শিক্ষা ও আল্লাহর বিধান প্রচার করতেন।
সমাজে দাওয়াত
ইয়াহইয়া (আ.) মানুষের মধ্যে ধর্মীয় সচেতনতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন।
তিনি:
- আল্লাহভীতি ও পরকালের প্রস্তুতির কথা বলতেন,
- জিনা, ব্যভিচার, সুদ, অন্যায় আচরণ ইত্যাদির বিরুদ্ধে স্পষ্ট ভাষায় বলতেন।
শহীদ হওয়া
সমাজের এক প্রভাবশালী ব্যক্তি এক নারীকে বিয়েতে আগ্রহী হয়, যা শরিয়তের দৃষ্টিতে অবৈধ ছিল।
ইয়াহইয়া (আ.) এই অনৈতিক সম্পর্কের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নেন।
এর ফলে ষড়যন্ত্র করে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
তিনি শহীদ হন এবং তাঁর রক্ত সেই স্থানকে রঞ্জিত করে দেয়। আল্লাহর কাছে তিনি একজন মর্যাদাপূর্ণ শহীদ হিসেবে অমর।
শিক্ষণীয় দিক
- সত্য কথা বলার জন্য জীবন উৎসর্গ করাই একজন নবীর পরিচয়।
- শৈশব থেকে আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করা সম্ভব — ইয়াহইয়া (আ.) ছিলেন সেই অনন্য দৃষ্টান্ত।
- একজন নবী শুধু শিক্ষা দেন না, নিজের জীবনে তা বাস্তবায়ন করে দেখান।
- অন্যায়ের সামনে নরম নয় — সত্যের উপর অবিচল থাকা ঈমানের পরিপূর্ণতা।
হজরত ঈসা (আ.) – অলৌকিক জন্ম, মহান শিক্ষা ও আসমানে উঠিয়ে নেওয়া
অলৌকিক জন্ম
হজরত ঈসা (আ.) জন্মগ্রহণ করেন বিনা পিতায়।
তাঁর মা হজরত মরিয়ম (আ.) ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক ও পবিত্র নারী।
আল্লাহ বলেন:
"আমি মরিয়ম ও তার পুত্রকে এক নিদর্শন করেছি।"
(সূরা মু’মিনুন: ৫০)
একদিন ফেরেশতা জিবরাঈল (আ.) মরিয়ম (আ.)-কে বলেন:
"আমি তোমার জন্য এক পবিত্র পুত্রের সুসংবাদ নিয়ে এসেছি।"
(সূরা মারিয়াম: ১৯)
শৈশবেই অলৌকিকতা
ঈসা (আ.) শিশুকালেই কথা বলেন।
তিনি বলেন:
"আমি আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং নবী করেছেন..."
(সূরা মারিয়াম: ৩০)
এই ঘটনা চারপাশের মানুষকে বিস্মিত করে তোলে।
নবুয়ত ও দাওয়াত
ঈসা (আ.)-কে আল্লাহ ইনজিল কিতাব দেন এবং বনী ইসরাইলের প্রতি নবী করে পাঠান।
তাঁর দাওয়াতের মূল বার্তা ছিল:
- আল্লাহর ইবাদত করো,
- তাওরাতকে মানো,
- নবীদের প্রতি ঈমান আনো,
- এবং নিজেকে আত্মশুদ্ধিতে নিয়োজিত করো।
তিনি বলেন:
"আমি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে নিদর্শনসহ এসেছি..."
(সূরা আলে ইমরান: ৪৯)
অলৌকিক ক্ষমতা
আল্লাহ ঈসা (আ.)-কে কিছু অলৌকিক শক্তি দেন, যেমন:
- মৃতকে আল্লাহর ইচ্ছায় জীবিত করা
- জন্মান্ধ ও কুষ্ঠরোগীকে নিরাময়
- মাটির পাখি বানিয়ে তাতে ফুঁ দিলে তা উড়ে যেত
- মানুষ যা খায় ও গোপন করে, তা জানিয়ে দিতেন
"এসব ছিল আল্লাহর আদেশে, তাঁর কুদরতের নিদর্শন।"
শত্রুদের ষড়যন্ত্র ও আল্লাহর রক্ষা
বনী ইসরাইলের কিছু লোক ঈসা (আ.)-এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তাঁকে হত্যা করতে চায়।
তবে আল্লাহ বলেন:
"তারা ঈসাকে হত্যা করেনি, শূলেও চড়ায়নি। বরং তাদের মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে (অন্য কাউকে ঈসা ভেবে)। বরং আল্লাহ তাঁকে উঠিয়ে নিয়েছেন নিজের দিকে।"
(সূরা নিসা: ১৫৭-১৫৮)
কিয়ামতের পূর্বে আগমন
ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী, ঈসা (আ.):
- কিয়ামতের পূর্বে পুনরায় পৃথিবীতে আগমন করবেন
- জালিম শক্তিকে ধ্বংস করবেন
- দাজ্জালকে হত্যা করবেন
- এবং পৃথিবীতে ইসলামের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন
এরপর তিনি স্বাভাবিকভাবে মৃত্যু বরণ করবেন।
শিক্ষণীয় দিক
- ঈসা (আ.)-এর জীবন ছিল আল্লাহর কুদরতের এক জীবন্ত নিদর্শন।
- তিনি ছিলেন সত্য ও শান্তির বার্তাবাহক।
- তাঁর জীবনের শিক্ষা— আল্লাহর উপর সম্পূর্ণ ভরসা, বিনয়, দয়া ও আত্মশুদ্ধি।
হজরত ইলিয়াস (আ.) – মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে সাহসী সংগ্রামী নবী
পরিচয়
হজরত ইলিয়াস (আ.) ছিলেন বনী ইসরাইলের মধ্যে প্রেরিত নবীদের একজন।
তাঁর নাম কুরআনে এসেছে:
"ইলিয়াসও ছিলেন রাসূলদের অন্তর্ভুক্ত।"
(সূরা আস-সাফফাত: ১২৩)
তাঁর নাম আরেক স্থানে এসেছে —
"সালাম হোক ইল ইয়াসিনের ওপর!"
(সূরা আস-সাফফাত: ১৩০)
(অনেকে বলেন “ইল ইয়াসিন” মানে ইলিয়াস ও তাঁর অনুসারীরা)
দাওয়াতের পটভূমি
ইলিয়াস (আ.)-এর কালে বনী ইসরাইলের অনেকে বাল (Ba‘l) নামের এক মূর্তির পূজায় লিপ্ত হয়।
এই বাল পূজার কেন্দ্র ছিল সিরিয়ার বালবেক শহর (বর্তমান লেবাননে অবস্থিত)।
মানুষের ঈমান দুর্বল হয়ে পড়ে, তারা ভুলে যায় আল্লাহর একত্ববাদ।
নবীর সাহসী দাওয়াত
হজরত ইলিয়াস (আ.) মানুষকে বললেন:
"তোমরা কি বালকে ডাকো এবং সৃষ্টিকর্তা সেরা আল্লাহকে ত্যাগ করো?"
(সূরা আস-সাফফাত: ১২৫)
তিনি বারবার বনী ইসরাইলকে সতর্ক করতেন:
- আল্লাহকে একমাত্র উপাস্য মনে করো
- পূর্বপুরুষদের সত্য দ্বীন অনুসরণ করো
- মূর্তিপূজা থেকে ফিরে এসো
কিন্তু অধিকাংশ লোক তাঁকে অস্বীকার করে এবং বিদ্রূপ করে।
আল্লাহর গজব
ইলিয়াস (আ.)-এর দোয়ায় আল্লাহ কয়েক বছর পর্যন্ত বৃষ্টি বন্ধ করে দেন —
ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষে সমাজ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
তবু মানুষ আল্লাহর দিকে ফিরে আসে না।
সীমিত অনুসারী, কিন্তু অটল ঈমান
যদিও তাঁর অনুসারী ছিলেন অল্প, কিন্তু ইলিয়াস (আ.) আল্লাহর প্রতি অবিচল থাকেন।
তিনি একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দাওয়াত দেন, কোনো পার্থিব স্বার্থ তাঁর দাওয়াতে ছিল না।
শিক্ষণীয় দিক
- মূর্তিপূজা বা শিরক ছিল ইলিয়াস (আ.)-এর সময়েও এক বড় ফিতনা — আজও তা রয়ে গেছে ভিন্ন রূপে।
- একজন সত্য নবী জনপ্রিয়তা নয়, বরং সত্য প্রচারেই অটল থাকেন।
- দাওয়াতের কাজ সহজ নয়, তবে সত্যের উপর অটল থাকা-ই সফলতা।
- আল্লাহর প্রতি ঈমান ও তাওহীদ প্রচার — এটাই নবীদের আসল দায়িত্ব।
হজরত আল ইয়াসা (আ.) – ধৈর্য, কৃতজ্ঞতা ও নেতৃত্বের প্রতীক
পরিচয়
আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন:
"ইসমাঈল, আল ইয়াসা এবং ইউনুস — এরা প্রত্যেকেই ছিলেন সৎকর্মপরায়ণদের অন্তর্ভুক্ত।"
(সূরা সাদ: ৪৮)
আবার বলেন:
"আর ইসমাঈল, আল ইয়াসা এবং যুলকিফলের কথা স্মরণ করো; তারা প্রত্যেকেই ছিল ধৈর্যশীল।"
(সূরা সোয়াদ: ৪৮)
এই আয়াতগুলো থেকে বোঝা যায় যে আল ইয়াসা (আ.) ছিলেন একজন মহান নবী, যার মধ্যে ছিল:
- ধৈর্য (সবর)
- কৃতজ্ঞতা (শুকর)
- এবং সৎকর্মের প্রতি নিষ্ঠা
নবুয়ত লাভ
ধারণা করা হয় যে তিনি ইলিয়াস (আ.)-এর পর বনী ইসরাইলে নবুয়তের দায়িত্ব পান।
ইলিয়াস (আ.) তাঁকে নিজের অনুসারীদের মধ্যে অন্যতম ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে দেখতেন।
তিনি নবী হিসেবে আল্লাহর পথে দাওয়াত, আল্লাহভীতি প্রচার, এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেন।
দায়িত্বশীল নেতৃত্ব
হজরত আল ইয়াসা (আ.)-এর যুগেও বনী ইসরাইলে:
- নৈতিক অবক্ষয়,
- দুনিয়ার প্রতি মোহ,
- এবং আল্লাহর বিধান থেকে বিচ্যুতি দেখা দিয়েছিল।
এই অবস্থায় তিনি:
- মানুষকে তাওহীদের পথে ডাকেন,
- শরীয়তের বিধান অনুযায়ী সমাজ পরিচালনা করেন,
- এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে ন্যায় ও সুবিচার কায়েম করেন।
কুরআনের স্বীকৃতি
যদিও কুরআনে হজরত আল ইয়াসা (আ.)-এর বিস্তারিত কাহিনী নেই, তবে তাঁকে যে সৎকর্মশীল ও ধৈর্যশীল নবী হিসেবে কুরআন স্বীকৃতি দিয়েছে — তা-ই তাঁর মর্যাদার প্রমাণ।
শিক্ষণীয় দিক
- ধৈর্য ও কৃতজ্ঞতা নবীজিদের বিশেষ গুণ — যা আমাদের জীবনেও গুরুত্বপূর্ণ।
- নেতৃত্বের আসনে থেকেও আল্লাহর বিধান অটুটভাবে মানা যায়, আল ইয়াসা (আ.) তার দৃষ্টান্ত।
- জনপ্রিয়তা নয়, বরং সঠিক পথে অবিচল থাকাই সাফল্যের মানদণ্ড।
- কঠিন সময়েও নিজের দায়িত্ব পালন করা — এটাই একজন প্রকৃত নবীর পরিচয়।
হজরত ইউনুস (আ.) – মাছের পেটে তওবা ও আল্লাহর দয়ার নিদর্শন
পরিচয়
হজরত ইউনুস (আ.)-কে কুরআনে "যুন-নূন" (মাছের সঙ্গী) এবং "সাহিবুল হুত" (মাছের সাথী) বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
আল্লাহ বলেন:
"যুন-নূনের কথা স্মরণ করো, যখন তিনি রাগান্বিত হয়ে চলে গিয়েছিলেন..."
(সূরা আল-আম্বিয়া: ৮৭)
দাওয়াত ও হতাশা
হজরত ইউনুস (আ.)-কে প্রেরণ করা হয় নাইনাওয়া নামক অঞ্চলের দিকে (বর্তমান ইরাকে)।
তাঁর কওম ছিল:
- আল্লাহকে অস্বীকারকারী
- নাফরমান ও মূর্তিপূজায় লিপ্ত
তিনি বারবার তাদের আল্লাহর দিকে ডাকেন, কিন্তু তারা তাঁর কথা শোনে না।
একসময় তিনি কওমের উপর রাগান্বিত হয়ে আল্লাহর আদেশ না নিয়েই শহর ত্যাগ করে চলে যান।
মাছের পেটে
সমুদ্রপথে যাওয়ার সময় তাঁর নৌকা ঝড়ে পড়ে।
লটারি করা হলে তাঁর নাম ওঠে, এবং তাঁকে পানিতে ফেলে দেওয়া হয়।
একটি বৃহৎ মাছ (অনেক মতানুযায়ী তিমি) তাঁকে গিলে ফেলে।
তখন তিনি গভীর অন্ধকারে —
(১) রাতের অন্ধকার
(২) সমুদ্রের গভীরতা
(৩) মাছের পেটের অন্ধকার —
এই তিন অন্ধকারে তওবা করে বলেন:
"লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজ জালিমিন"
(সূরা আল-আম্বিয়া: ৮৭)
অর্থ: “আপনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, আপনি পবিত্র, আমি অবশ্যই জালেমদের অন্তর্ভুক্ত।”
মুক্তি ও ফিরে আসা
আল্লাহ তাঁর তওবা কবুল করেন এবং মাছকে আদেশ দেন ইউনুস (আ.)-কে উপকূলে ফেলে দিতে।
তিনি অসুস্থ অবস্থায় ফিরে আসেন।
আল্লাহ তাঁকে সুস্থ করেন এবং ফের নবুয়তের দায়িত্ব দেন।
কওমের হিদায়াত
ইউনুস (আ.) তাঁর কওমে ফিরে গেলে তারা এইবার তাঁর কথা মেনে নেয়।
আল্লাহ তাদের গজব থেকে রক্ষা করেন।
এই ঘটনা প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন:
"অবশেষে তারা ঈমান আনলে আমি তাদের গজব তুলে নেই এবং নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত জীবন দান করি।"
(সূরা আস-সাফফাত: ১৪৮)
শিক্ষণীয় দিক
- আল্লাহর আদেশ ছাড়া কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয় — তা নবী হলেও।
- বিপদের সময় তওবা, দোয়া ও আল্লাহর স্মরণই উদ্ধার করতে পারে।
- "লা ইলাহা ইল্লা আনতা..." — এ দোয়া আজও সকল বিপদে মুক্তির চাবিকাঠি।
- আল্লাহ তাঁর বান্দার তওবা কবুল করতে সবচেয়ে উদার — কেবল ফিরে আসতে হয়।
হেকিম লূকমান (আ.) – প্রজ্ঞাবান পিতা ও আদর্শ উপদেশদাতা
পরিচয়
হজরত লূকমান (আ.)-এর নাম এসেছে সূরা লূকমান-এ।
তিনি ছিলেন:
- আফ্রিকার নুবিয়া বা ইথিওপিয়া অঞ্চলের অধিবাসী
- দাস থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন (অনেক মতানুযায়ী)
- অত্যন্ত প্রজ্ঞাবান ও আল্লাহভক্ত
প্রজ্ঞা ও জ্ঞান
আল্লাহ তাআলা বলেন:
"আমি লূকমানকে হিকমত (প্রজ্ঞা) দান করেছিলাম..."
(সূরা লূকমান: ১২)
তাঁকে যে হিকমত দেওয়া হয়েছিল, তা কেবল জ্ঞান নয়, বরং:
- চিন্তার গভীরতা
- জীবনের বাস্তবতা বোঝার ক্ষমতা
- সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা
পুত্রকে উপদেশ
লূকমান (আ.) তাঁর ছেলেকে যে উপদেশ দেন, তা সূরা লূকমানে অত্যন্ত সুন্দরভাবে এসেছে। নিচে মূল উপদেশগুলো দেওয়া হলো:
১. তাওহীদের শিক্ষা
"হে আমার ছেলে, আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করো না। নিশ্চয়ই শিরক একটি মহা অন্যায়।"
(সূরা লূকমান: ১৩)
২. মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার
"তোমার মা কষ্টসহকারে তোমাকে গর্ভে ধারণ করেছেন... অতএব তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ হও..."
(সূরা লূকমান: ১৪)
৩. আল্লাহ সবকিছু জানেন
"তোমার কাজ একটি সরিষা দানার সমানও যদি হয়... আল্লাহ তা নিয়ে আসবেন..."
(সূরা লূকমান: ১৬)
৪. নামাজ কায়েম করা
"নামাজ কায়েম করো..."
(সূরা লূকমান: ১৭)
৫. সৎকাজের নির্দেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ
"সৎকাজের আদেশ দাও ও অসৎ কাজে বাধা দাও..."
(সূরা লূকমান: ১৭)
৬. ধৈর্য ধরো
"তুমি যে বিপদে পড়বে, তা সহ্য করো — নিশ্চয়ই ধৈর্য গুণের কাজ।"
(সূরা লূকমান: ১৭)
৭. অহংকার ও রুক্ষতা থেকে বিরত থাকা
"অহংকার করে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ো না... দম্ভভরে হাঁটিও না..."
(সূরা লূকমান: ১৮)
৮. নম্রতা ও ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ
"চলাফেরায় সংযত থেকো এবং কণ্ঠস্বর নিচু করো..."
(সূরা লূকমান: ১৯)
"... নিশ্চয়ই গাধার চিৎকার সবচেয়ে কুৎসিত।"
শিক্ষণীয় দিক
- আল্লাহর ওপর ঈমান এবং শিরক থেকে দূরে থাকা সর্বপ্রথম শিক্ষা।
- একজন পিতা কীভাবে নিজের সন্তানকে বাস্তব, আখিরাত ও নৈতিকতা সম্পর্কে শিক্ষা দিতে পারে — লূকমান (আ.) তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।
- নম্রতা, ধৈর্য, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং দায়িত্ববোধ — একজন মুসলিমের অন্যতম গুণ।
- শিক্ষার মাধ্যমে সমাজ ও পরিবার গঠনের গুরুত্ব তাঁর দৃষ্টান্তে স্পষ্ট।
হজরত ইউশা (আ.) – বিজয়ী নেতা ও মূসা (আ.)-এর যোগ্য উত্তরসূরি
পরিচয়
- ইউশা ইবনে নূন (আ.) ছিলেন হজরত মূসা (আ.)-এর একজন ঘনিষ্ঠ সহচর।
- তিনি ছিলেন ইসরাইলি গোত্রে জন্মগ্রহণকারী, এবং বনী ইসরাইলের মাঝে নবুয়তপ্রাপ্ত।
- যদিও কুরআনে তাঁর নাম সরাসরি উল্লেখ নেই, তবে হাদীস ও ইসলামী ঐতিহাসিক গ্রন্থে তাঁর উল্লেখ আছে।
নবুয়ত ও দায়িত্ব
হজরত মূসা (আ.) যখন মৃত্যুবরণ করেন, তখন আল্লাহ তাআলা ইউশা (আ.)-কে নবুয়তের দায়িত্ব দেন।
তাঁর নেতৃত্বে:
- বনী ইসরাইল জর্দান নদী পার হয়,
- এবং অবশেষে ফিলিস্তিনে প্রবেশ করে,
- যা ছিল বহু বছর ধরে প্রতীক্ষিত "পবিত্র ভূমি"।
বিশিষ্ট ঘটনা: সূর্য থেমে যাওয়া
একবার যুদ্ধ চলাকালীন সময়, সূর্য ডুবে যাচ্ছিল —
তখন ইউশা (আ.) দোয়া করলেন যেন সূর্য ডুবে না যায়,
কারণ বিজয় তখনো সম্পূর্ণ হয়নি।
রাসূল (সা.) বলেন:
“সূর্যকে একবার থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল একজন মানুষের জন্য — তিনি ছিলেন ইউশা (আ.)।"
(সহিহ বুখারি, হাদীস: ৩১২৪)
বিজয় ও স্থিতিশীলতা
ইউশা (আ.)-এর নেতৃত্বে বনী ইসরাইল বহু যুদ্ধ জয় করে এবং বহু বছর শান্তিতে বসবাস করে।
তিনি:
- আল্লাহর বিধান অনুযায়ী শাসন চালান
- ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেন
- এবং মানুষকে আল্লাহর পথে রাখেন
শিক্ষণীয় দিক
- আল্লাহর ওপর নির্ভর করলে অসম্ভব জয় সম্ভব — ইউশা (আ.)-এর নেতৃত্বে এর প্রমাণ মেলে।
- সাহস, দূরদৃষ্টি ও আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা — একজন প্রকৃত নেতার বৈশিষ্ট্য।
- আল্লাহর আনুগত্য ও নেতৃত্বের গুণে, একটি জাতিকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
হজরত দাউদ (আ.) – নবী, বাদশাহ ও জালুত-বিজয়ী বীর
পরিচয়
- হজরত দাউদ (আ.) ছিলেন বনী ইসরাইলের একজন প্রভাবশালী নবী ও রাজা।
- আল্লাহ তাআলা তাঁকে নবুয়ত ও রাজত্ব উভয়ই দান করেন।
- তিনি ছিলেন হজরত সুলাইমান (আ.)-এর পিতা।
আল্লাহ বলেন:
"আর দাউদ ও সুলাইমানকে আমি জ্ঞান দান করেছিলাম..."
(সূরা আন-নামল: ১৫)
তরুণ বয়সের বীরত্ব: জালুতের বিরুদ্ধে বিজয়
- তরুণ বয়সে দাউদ (আ.) তৎকালীন শক্তিশালী রাজা জালুতকে (Goliath) পরাজিত করেন।
- এই যুদ্ধে তাঁর নেতৃত্বে বনী ইসরাইল বিজয় লাভ করে।
- এর মাধ্যমে তিনি বনী ইসরাইলের মাঝে খ্যাতি অর্জন করেন।
আল্লাহ বলেন:
"আর দাউদ জালুতকে হত্যা করল, আর আমি তাকে রাজত্ব ও হিকমত (প্রজ্ঞা) দান করলাম।"
(সূরা আল-বাকারা: ২৫১)
রাজত্ব ও ন্যায়বিচার
- আল্লাহ তাঁকে রাজত্ব দান করেন এবং তিনি ছিলেন অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ শাসক।
- তিনি দিনের একটি অংশ দাওয়াত ও বিচার-এর কাজে এবং একটি অংশ ইবাদতে ব্যয় করতেন।
- তাঁর বিচার ও ফয়সালা ছিল আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে।
জবানের কণ্ঠ ও তাওরাত
- দাউদ (আ.)-কে তাওরাত দেওয়া হয়েছিল এবং তিনি ছিলেন অত্যন্ত সুমধুর কণ্ঠের অধিকারী।
- তিনি যখন জিকির করতেন, তখন:
- পর্বত ও পাখিরা তাঁর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আল্লাহর তাসবীহ পাঠ করত।
আল্লাহ বলেন:
"আমি পর্বতমালা ও পাখিদের তাঁর সঙ্গে তাসবীহ পাঠ করার জন্য নিয়োজিত করেছিলাম।"
(সূরা সাদ: ১৮–১৯)
লৌহ নমনীয় করা
- আল্লাহ দাউদ (আ.)-কে লোহা নরম করার ক্ষমতা দেন।
- তিনি নিজ হাতে যুদ্ধের বর্ম (যন্ত্রাংশ) তৈরি করতেন, যা ছিল তখনকার প্রযুক্তিগত অগ্রগতি।
আল্লাহ বলেন:
"আমি তার জন্য লোহা নমনীয় করে দিয়েছিলাম।"
(সূরা সাবা: ১০)
মৃত্যুর পর
- দাউদ (আ.) মৃত্যুবরণ করলে তাঁর পুত্র সুলাইমান (আ.) নবুয়তের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
শিক্ষণীয় দিক
- সাহস ও ঈমান থাকলে তরুণ বয়সেও বড় বিজয় সম্ভব — দাউদ (আ.)-এর মতো।
- ন্যায়বিচার ও নেতৃত্ব ইসলামি শাসনের গুরুত্বপূর্ণ দিক।
- আল্লাহর জিকির ও তাওয়াক্কুল — মানুষের জীবনে প্রশান্তি ও শক্তির উৎস।
- দুনিয়ার দায়িত্ব ও ইবাদতের মধ্যে সুন্দর ভারসাম্যই প্রকৃত সফলতা।
হজরত সুলাইমান (আ.) – নবী, রাজা ও অলৌকিক শক্তির অধিকারী
পরিচয়
- হজরত সুলাইমান (আ.) ছিলেন হজরত দাউদ (আ.)-এর পুত্র।
- তিনি ছিলেন নবী, রাজা এবং এক অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন শাসক।
- আল্লাহ তাঁকে শুধু নবুয়তই দেননি, বরং এমন ক্ষমতাও দেন যা অন্য কাউকে দেননি।
আল্লাহ বলেন:
"হে আমার রব, আমাকে ক্ষমা করুন এবং আমাকে এমন রাজত্ব দিন যা আমার পর আর কাউকে দেবেন না।"
(সূরা সাদ: ৩৫)
সুলাইমান (আ.)-এর বিশেষ ক্ষমতাসমূহ
১. জ্বিন ও দানবদের অধীনতা
- জ্বিনরা তাঁর অধীনে কাজ করত — কেউ পাথর কাটত, কেউ প্রাসাদ তৈরি করত, কেউ সমুদ্রের গভীরে ডুব দিত।
"জ্বিনদের মধ্যে এমন কিছু আমি তাঁর অধীনে করেছিলাম যারা তাঁর জন্য নির্মাণকাজ করত..."
(সূরা সাবা: ১২)
২. পশু-পাখির ভাষা বোঝা
- সুলাইমান (আ.) পশু ও পাখির ভাষা বুঝতেন।
- একবার তিনি একটি পিপঁড়ার কথা শুনে হাসলেন এবং আল্লাহর শোকর আদায় করলেন।
"হে আমার প্রতিপালক! আমাকে অনুগ্রহ করুন, যাতে আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারি..."
(সূরা আন-নামল: ১৯)
৩. হাওয়া নিয়ন্ত্রণ
- তাঁর জন্য হাওয়াকে করায়ত্ত করা হয়েছিল।
- একদিনে বহু মাসের পথ পাড়ি দিতে পারতেন।
"আমি তাঁর জন্য হাওয়াকে নিয়োজিত করেছিলাম — সকালে তা এক মাসের পথ পাড়ি দিত..."
(সূরা সাবা: ১২)
৪. অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাসন
- তিনি কঠোর ন্যায়বিচার চালাতেন এবং শিরক ও অবাধ্যতা বরদাস্ত করতেন না।
রানী বিলকিসের ঘটনা (সাবার রানী)
- সুলাইমান (আ.)-এর পক্ষ থেকে রানী বিলকিসের দরবারে চিঠি পাঠানো হয়।
- পাখি হুদহুদ এই চিঠি পৌঁছে দেয়।
- বিলকিস অবাক হয়ে তাঁর প্রাসাদে আসেন এবং ইসলামে দীক্ষিত হন।
"সে বলল, হে আমার প্রতিপালক, আমি নিজের উপর যুলুম করেছি। আমি দাউদ ও সুলাইমানের আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করছি।"
(সূরা আন-নামল: ৪৪)
মৃত্যুর দৃশ্য
- সুলাইমান (আ.) একটি লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন —
- জ্বিনরা কাজ করে যাচ্ছিল, ভাবছিলেন তিনি জীবিত।
- তিনি মৃত্যুবরণ করেন, কিন্তু তাঁর মৃত্যুর খবর তখনো কেউ জানত না।
"তাঁর মৃত্যু যখন হলো, তখন এক কীট তাঁর লাঠি কেটে ফেলল..."
(সূরা সাবা: ১৪)
শিক্ষণীয় দিক
- নবী হয়েও তিনি রাজা ছিলেন — দুনিয়া ও আখিরাতের ভারসাম্য তাঁর মধ্যে ছিল।
- ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বিনয়ী ও শোকরগুজার ছিলেন।
- জ্ঞান, নেতৃত্ব, ও বিচক্ষণতার অনন্য দৃষ্টান্ত ছিলেন।
- তিনি শিখিয়ে গেছেন যে ক্ষমতা আল্লাহর দান, অহংকারের বস্তু নয়।
হজরত মুহাম্মদ (সা.) – সর্বশেষ নবী, রহমাতুল্লিল আলামিন
পরিচয়
- হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন আল্লাহর সর্বশেষ প্রেরিত নবী ও রাসূল।
- তাঁর আগমন ছিল সমস্ত মানবজাতির জন্য রহমত।
- তিনি ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে মক্কায় কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন।
আল্লাহ বলেন:
"আর আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমত স্বরূপই প্রেরণ করেছি।"
(সূরা আল-আম্বিয়া: ১০৭)
শৈশব ও যৌবন
- পিতৃহীন অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেন, মায়ের মৃত্যুর পর দাদু ও পরে চাচা আবু তালিব তাঁকে লালন-পালন করেন।
- ছোটবেলা থেকেই ছিলেন সত্যবাদী ও আমানতদার — "আল-আমিন" উপাধিতে ভূষিত হন।
- ব্যবসার কাজে প্রিয় স্ত্রী খাদিজা (রা.)-এর সঙ্গে পরিচয় ও পরে বিবাহ।
নবুয়তের প্রাপ্তি
- ৪০ বছর বয়সে হেরা গুহায় ধ্যানরত অবস্থায় প্রথম ওহি লাভ করেন।
- জিবরাঈল (আ.) তাঁর কাছে সূরা আলাক-এর প্রথম আয়াত নিয়ে আসেন।
"পড়ো তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন..."
(সূরা আলাক: ১)
দাওয়াত ও কষ্ট
- প্রথমে গোপনে, পরে প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার শুরু করেন।
- কুরাইশরা তাঁকে ও সাহাবিদের উপর কঠোর নির্যাতন চালায়।
- তায়েফে তাঁকে পাথর মেরে রক্তাক্ত করা হয়, তবুও তিনি বদদোয়া না করে তাদের জন্য হেদায়াত কামনা করেন।
হিজরত ও মদিনায় ইসলামি রাষ্ট্র
- দীর্ঘ নির্যাতনের পর সাহাবিদের সঙ্গে মদিনায় হিজরত করেন।
- মদিনায় পৌঁছে প্রথম ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে মুসলমান, ইহুদি ও খ্রিষ্টান একসাথে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করত।
- মসজিদে নববী প্রতিষ্ঠা করেন এবং সমাজের ন্যায়-নীতি নিশ্চিত করেন।
যুদ্ধ ও শান্তি
- বদর, উহুদ, খন্দকসহ নানা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন, যেখানে কৌশল, ধৈর্য ও ন্যায়বিচারের পরিচয় দেন।
- ফাতেহ মক্কা (মক্কা বিজয়) তাঁর মহানুভবতার এক নিদর্শন — তিনি শত্রুদেরও ক্ষমা করে দেন।
ইহসান, ন্যায় ও দয়া
- এত বড় নেতা হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন নম্র, দয়ালু ও বিনয়ী।
- তিনি গরীব, এতিম, বিধবা ও দাসদের অধিকার রক্ষা করতেন।
- স্ত্রীদের প্রতি সদ্ব্যবহার, শিশুর প্রতি দয়া, প্রতিবেশীর হক — সবই তাঁর জীবনের অংশ ছিল।
মৃত্যু ও বিদায় হজ
- জীবনের শেষ বছর তিনি বিদায় হজ আদায় করেন।
- সেখানে তিনি বলেন:
"হে মানুষ, আমি তোমাদের উপর আল্লাহর দ্বীন পৌঁছে দিয়েছি কি না?"
তারা বলল: "জি, আপনি পৌঁছে দিয়েছেন।"
তিনি বললেন: "হে আল্লাহ, সাক্ষী থাকুন!"
- ৬৩ বছর বয়সে তিনি মদীনায় মৃত্যুবরণ করেন।
শিক্ষণীয় দিক
- আখলাক ও চরিত্রের সর্বোচ্চ উদাহরণ ছিলেন তিনি।
- সত্যবাদিতা, সহনশীলতা, বিনয়, নেতৃত্ব, দয়া, সাহসিকতা — সব ছিল তাঁর জীবনে পরিপূর্ণ।
- তিনি ছিলেন জীবন্ত কুরআন — “তাঁর চরিত্র ছিল কুরআন” (হাদীস)।
উপসংহার
হজরত মুহাম্মদ (সা.) শুধু একটি জাতির নয়, বরং সমগ্র মানবতার মুক্তির দূত।
তাঁর জীবনকে জানা মানেই সত্যিকারের জীবন শিক্ষা ও আলো পেতে পারা।