15 Jan, 2025
হিউম্যান মেটাপনিউম ভাইরাস: লক্ষণ, কারণ এবং প্রতিরোধের উপায়
হিউম্যান মেটাপনিউম ভাইরাস: লক্ষণ, কারণ এবং প্রতিরোধের উপায়
হিউম্যান মেটাপনিউমোভাইরাস
হিউম্যান মেটাপনিউমোভাইরাস (HMPV) একটি শ্বাসযন্ত্রজনিত ভাইরাস যা মানুষের ফুসফুস এবং শ্বাসনালীতে সংক্রমিত হয়। এটি Paramyxoviridae পরিবারের সদস্য এবং রেসপিরেটরি সিনসিশিয়াল ভাইরাস (RSV) -এর মতোই। এটি সাধারণ সর্দি থেকে শুরু করে গুরুতর রোগ যেমন নিউমোনিয়া এবং ব্রঙ্কিওলাইটিসের কারণ হতে পারে।
উৎপত্তি ও ইতিহাস
এই ভাইরাসটি সর্বপ্রথম ২০০১ সালে ডাচ ভাইরোলজিস্ট আবিষ্কার করেন। তারা প্রমাণ পান যে, HMPV কমপক্ষে ৫০ বছর ধরে মানবদেহে সংক্রমণ ঘটিয়ে আসছে।
হিউম্যান মেটাপনিউমোভাইরাস (HMPV) এর লক্ষণ:
HMPV সংক্রমণের লক্ষণগুলি ছোট থেকে গুরুতর আকার ধারণ করতে পারে। সাধারণত সংক্রমণের ৩-৬ দিনের মধ্যে লক্ষণ দেখা দেয়।
সাধারণ লক্ষণ:
- সর্দি
- কাশি
- নাক বন্ধ হওয়া বা নাক দিয়ে পানি পড়া
- গলা ব্যথা
- জ্বর (মৃদু থেকে মাঝারি মাত্রায়)
- ক্লান্তি বা দুর্বলতা
গুরুতর লক্ষণ :
- শ্বাসকষ্ট
- ব্রঙ্কিওলাইটিস (ফুসফুসের ছোট নালীগুলোর প্রদাহ)
- নিউমোনিয়া
- পানি খাওয়া নিয়ে সমস্যা (ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে)
- শ্বাসে শোঁ শোঁ শব্দ বের হওয়া
প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে লক্ষণ:
- কাশি
- নাক দিয়ে পানি পড়া
- জ্বর
- ক্লান্তি
- শ্বাস নিতে কষ্ট
শিশুদের মধ্যে লক্ষণ:
- শ্বাসকষ্ট
- উচ্চ জ্বর
- ডিহাইড্রেশন
ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তি :
শিশু: পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরা ব্রঙ্কিওলাইটিস বা নিউমোনিয়ার ঝুঁকিতে বেশি।
বয়স্ক: ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে গুরুতর শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা হতে পারে।
গর্ভবতী নারী: শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে।
ইমিউনোকম্প্রোমাইজড ব্যক্তি: রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল থাকলে গুরুতর উপসর্গ হতে পারে।
দুর্বল ব্যক্তি: দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি
অ্যাজমা, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (COPD), বা হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তি
HMPV ছড়ানোর উপায় :
হিউম্যান মেটাপনিউমোভাইরাস (HMPV) মূলত শ্বাসযন্ত্রের ভাইরাস, যা একজন আক্রান্ত ব্যক্তির কাছ থেকে অন্য ব্যক্তিতে সহজেই ছড়াতে পারে। এই ভাইরাসের সংক্রমণ পদ্ধতি বেশিরভাগ শ্বাসযন্ত্রের অন্যান্য ভাইরাসের মতো।
- আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে ভাইরাসটি বাতাসে ছড়ায়।
- এই ভাইরাসযুক্ত ড্রপলেট কাছাকাছি থাকা অন্য ব্যক্তির শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে।
- আক্রান্ত ব্যক্তির স্পর্শ করা (যেমন: হাত মেলানো)।
- ভাইরাস-দূষিত পৃষ্ঠ বা বস্তু (যেমন: দরজার হাতল, মোবাইল, খেলনা) স্পর্শ করার পর হাত না ধুয়ে মুখ, নাক, বা চোখ স্পর্শ করলে।
- একই ঘরে দীর্ঘক্ষণ থাকা।
- একসঙ্গে খাবার খাওয়া বা পানীয় ভাগাভাগি করা।
- বাচ্চাদের ক্ষেত্রে খেলনা বা অন্যান্য জিনিস মুখে দেওয়া।
- ভাইরাস ছড়ানোর ঝুঁকিপূর্ণ স্থান ও সময়
- ঘনবসতিপূর্ণ স্থান: যেমন স্কুল, অফিস, বাজার, ও হাসপাতাল।
- শীতকাল বা বসন্তকাল: এই সময়ে ভাইরাস সংক্রমণ বেশি দেখা যায়।
- দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি: বাচ্চা, বয়স্ক, এবং যাঁরা ইতিমধ্যেই অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত
কিভাবে HMPV নির্ণয় করা হয়?
HMPV নির্ণয় করার জন্য নির্দিষ্ট পরীক্ষাগার পরীক্ষার প্রয়োজন হয়, কারণ এর লক্ষণগুলি অন্যান্য শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের মতোই হতে পারে। সাধারণত ব্যবহৃত নির্ণয়ের পদ্ধতিগুলি হলো:
এইচএমপিভি পিসিআর পরীক্ষা:
- ভাইরাসের জেনেটিক উপাদান সনাক্ত করতে এই আণবিক পরীক্ষা করা হয়।
- এটি উচ্চ নির্ভুলতার সাথে এইচএমপিভি শনাক্ত করতে পারে এবং এটি একটি সোনার মান হিসাবে বিবেচিত।
দ্রুত অ্যান্টিজেন পরীক্ষা:
- দ্রুত ফলাফল দেয়।
- তবে এটি পিসিআর পরীক্ষার তুলনায় কম সংবেদনশীল।
ব্রঙ্কোস্কোপি:
- ফুসফুসের শ্বাসনালীতে পরিবর্তন দেখতে ব্রঙ্কোস্কোপি ব্যবহার করা যেতে পারে।
- যখন উপসর্গ গুরুতর হয় এবং HMPV সন্দেহ হয়, তখন সঠিক নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী এই পরীক্ষাগুলি করা গুরুত্বপূর্ণ।
হিউম্যান মেটাপনিউমোভাইরাস (HMPV) এর চিকিৎসা
নির্দিষ্ট ওষুধ নেই: HMPV-এর জন্য কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ বা ভ্যাকসিন নেই। চিকিৎসা লক্ষণ উপশমে কেন্দ্রীভূত হয়।
- বিশ্রাম: শরীরকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম দিন।
- পানীয় গ্রহণ: শরীর হাইড্রেট রাখতে প্রচুর পানি, স্যুপ, বা গরম পানীয় পান করুন।
- পেইন রিলিভার: জ্বর বা গলা ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল ব্যবহার করা যেতে পারে (চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে)।
- হাঁপানির চিকিৎসা: শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানির জন্য ব্রংকোডাইলেটর ঔষধ।
গুরুতর ক্ষেত্রে:
- গুরুতর নিউমোনিয়া বা শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করা প্রয়োজন হতে পারে।
- অক্সিজেন থেরাপি বা ভেন্টিলেটরের প্রয়োজন হতে পারে।
প্রতিরোধের উপায়
• হাত ধোয়া: সাবান ও পানি দিয়ে নিয়মিত হাত ধুতে হবে।
• মাস্ক ব্যবহার: সংক্রমণের সময় মাস্ক ব্যবহার করুন।
• সংস্পর্শ এড়ানো: অসুস্থ ব্যক্তির কাছ থেকে দূরে থাকুন।
• শিশুদের যত্ন: শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ হলে তাদের সুরক্ষিত রাখতে বাড়তি সতর্কতা নিন।
• জিনিসপত্র পরিষ্কার রাখা: সংক্রমণ এড়াতে ঘরের পৃষ্ঠ বা ব্যবহৃত জিনিসপত্র পরিষ্কার রাখুন।
• অসুস্থ থাকলে বাড়িতে থাকা।
প্রাকৃতিক পদ্ধতি:
Human Metapneumovirus (HMPV)-এর জন্য নির্দিষ্ট কোনো অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ বা ভ্যাকসিন বর্তমান বিশ্বে নেই। এটি সাধারণত নিজের থেকেই ভালো হয়ে যায়। তবে, লক্ষণগুলির তীব্রতা অনুযায়ী কিছু চিকিৎসার বিকল্প ব্যবহার করা যেতে পারে।
- গরম পানির কুলাকুলি করা।
- আদা-চা বা মধু দিয়ে গলা পরিষ্কার করা।
- পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং পুষ্টিকর খাবার খাওয়া।
- লেবুর রস খাওয়া চিনি ছাড়া
- গরম পানি খাওয়া
হিউম্যান মেটাপনিউম আক্রান্ত ব্যক্তির খাবার
হিউম্যান মেটাপনিউমোভাইরাস (HMPV) আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য পুষ্টিকর খাবার গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি রোগীর শরীরকে দ্রুত সুস্থ করতে সাহায্য করে। সংক্রমণ চলাকালীন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য সঠিক খাবারের ভূমিকা অনেক বেশি।
১. প্রচুর তরল পানীয়
- পানির পরিমাণ বাড়ান: ডি-হাইড্রেশন এড়াতে দিনে বেশি করে পানি পান করুন।
- গরম স্যুপ: চিকেন স্যুপ বা শাকসবজির স্যুপ গলা আরাম দেয় এবং পুষ্টি জোগায়।
- হারবাল চা: আদা, লেবু, এবং মধু মিশ্রিত চা কাশি ও গলা ব্যথা কমায়।
- ডাবের পানি: প্রাকৃতিক ইলেক্ট্রোলাইট সরবরাহ করে।
- ফলের রস: বিশেষ করে কমলার রস, যা ভিটামিন সি সরবরাহ করে। তবে চিনি যুক্ত না হওয়া ভালো।
২. পুষ্টিকর খাবার
- প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার: মুরগি, ডিম, মসুর ডাল, বা মাছ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
- শাকসবজি: ব্রকোলি, গাজর, পালং শাক, বা টমেটোর মতো অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ সবজি শরীরকে ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে।
- ফলমূল: কমলা,মালটা, সবুজ মালটা, লেবু, টমেটো, পেয়ারা, কিউই, বা বেরি জাতীয় ফলে ভিটামিন সি বেশি থাকে, যা প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
- শস্যজাত খাবার: ওটস, বাদামি, গমের রুটি ।
৩. সহজপাচ্য খাবার
- হালকা খিচুড়ি বা সিদ্ধ ডাল।
- সিদ্ধ মিষ্টি আলু ।
- দই: এতে প্রোবায়োটিক থাকে, যা হজমশক্তি উন্নত করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
কী খাবার এড়াবেন
- ভাজা-পোড়া বা অতিরিক্ত তৈলাক্ত খাবার।
- অতিরিক্ত মিষ্টি জাতীয় খাবার: এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল করে।
- ঠান্ডা খাবার বা পানীয়: গলা ব্যথা বাড়াতে পারে।
- অ্যালকোহল ও ক্যাফেইন: এটি ডি-হাইড্রেশন সৃষ্টি করতে পারে।
বাড়তি যত্ন
- খাবার নিয়মিত ও পরিমাণমতো খান।
- জ্বর বা ক্লান্তির কারণে খাওয়ার ইচ্ছে না থাকলেও হালকা খাবার খাওয়ার চেষ্টা করুন।
- পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন এবং পুষ্টিকর খাবার খান।
- এই ডায়েট ফলো করলে রোগী দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে এবং শরীরের শক্তি ফিরে পাবে।