নৌকায় ভ্রমণ প্রবন্ধ রচনা বা নৌকায় ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে রচনা

নৌকায় ভ্রমণ প্রবন্ধ রচনা বা নৌকায় ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে রচনা

নৌকায় ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বা নৌকায় ভ্রমণ রচনা
নৌকায় ভ্রমণ প্রবন্ধ রচনা বা

নৌকায় ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে রচনা 
অথবা 
নৌকা ভ্রমণ 
রচনা
 
সংকেত: ভূমিকা পূর্বকথা আয়োজন যাত্রা বর্ণনা উপসংহার
 
ভূমিকা : অসংখ্য নদ-নদী আর খাল-বিলের দেশ বাংলাদেশ । আমাদের এই দেশে এমন কোনো শহর-বন্দর-নগর-গ্রাম খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে কোনো নদ-নদীর উপস্থিতি নেই। তাই বাঙালির অস্তিত্বের সাথে মিশে আছে নদী ও নৌকা । বর্তমান সভ্যতার উন্নতির ফলে নৌপথের সংকীর্ণতা ধীরে ধীরে দেখা দিচ্ছে। বর্তমানে নদীতে পুল নির্মাণ করে ট্রেন, মোটরযান প্রভৃতি চলাচলের সুযোগ ঘটেছে। আকাশ পথে চলাচলের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কোনো কোনো এলাকায় পরিবেশ পরিবর্তনের ফলে সেখানে নদী বা বিল নেই তাই সেখানে নৌকার ব্যবহারও নেই । তাই নৌকারোহণ ও ভ্রমণের কথা শুনলেই বুকের রক্তে আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়। কেন যেন মনে হয় চিরপরিচিত নদীগুলো যেন তার বুকে হাতছানিতে দিয়ে আমাদের ডাকে। শহরে বসবাসরত মানুষের নৌকা ভ্রমণের আনন্দ অনুভূতি আরও তীব্রতর হয়ে থাকে। 

পূর্বকথা : আমি শহরের কলেজে লেখাপড়া করি। খুলনার দুবিরিয়া উপজেলার তরফপুর ইউনিয়নের গ্রামে বাবা-মায়ের সাথে কাকার বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে যাওয়ার উপলক্ষ বেড়ানো নয়, আমার ছোট কাকার বিয়ের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে আসা। বিয়ের কথা শুনে মনে কিছুটা রোমাঞ্চ ভাব অনুভব করলাম। আমার ছোট কাকা সেনাবাহিনীতে চাকরি করেন। আমার খুবই আদরের মানুষ তিনি। আমার কোনো আবদার এ পর্যন্ত তিনি প্রত্যাখ্যান করেন নি। আমাকে খুব আদর ও স্নেহ করেন। খোঁজ নিয়ে জানলাম, পরের দিন শুত্রুবার তিনি একদল যাত্রীসহ বিয়ে করতে যাবেন। এ উদ্দেশ্যে একটি বাস ও একটি মাইক্রোবাস এবং একটি কার ভাড়া করা হলো। আমি ছোট কাকার কানে কানে কিছু কথা বললাম। শুনে ছোট্ট কাকার হেসে বললেন, “তাই নাকি; আচ্ছা ভাতিজা সেটাই হবে। তোর কথা শুনে তো আমারও কেমন যেন খুশি খুশি ভাব লাগছে।” 

আয়োজন : আমার ছোট কাকা হঠাৎ ঘোষণা করলেন, “ময়ূরপঙ্খী নৌকা সাজাও। ময়ূরপঙ্খী নৌকায় আমি বউ আনতে যাব।” সবার চক্ষু চড়কগাছ। বলে কি ছোকড়া! আজকাল কি আর ময়ূরপঙ্খী নৌকার প্রচলন আছে নাকি। আর তাছাড়া তরফপুর গ্রাম রাস্তা পথে মাত্র ছয় কিলোমিটার। অথচ নদীপথ বেছে নিলে কমপক্ষে পঁচিশ কিলোমিটার হবে। কাকা বললেন, কুছ পরওয়া নেই। সবাই যাবে রাস্তা পথে। আমি এবং আমার ভাতিজা, বাদক দল, মাঝি-মাল্লা পরিবেষ্টিত হয়ে নৌপথে যাব। বলাবাহুল্য আমার কাকা তাদের বড় ভাই। এ খামখেয়ালিতে রেগে উঠতে গিয়েও পরে মুচকে হাসলেন। বুঝতে পারলেন, ছোট কাকার এ খামখেয়ালিপনা হয়তো আমারই মস্তিষ্কের উদ্ভট ফসল। তাই তিনি বললেন, "ওর (ছোট কাকার) বিয়ে, ওর যেমন ইচ্ছা বউ আনতে যাবে। এতে কোনো আপত্তি থাকতে পারে না। আর কি! বাবার কথার পর পর আর কারও কথা চলে না। কাকার সাঙ্গ-পাঙ্গরা মাঝারি আকৃতির একটা ট্রলার ভাড়া করল। পুরোদিন ধরে ট্রলারটিকে বাঁশ এবং রঙিন কাপড়ের সাহায্যে ময়ূরপঙ্খীর আকৃতিতে সাজানো হলো। মধুমতি নদী কাকাদের বাড়ির কাছে। খুশিতে বাগবাগ হয়ে ট্রলার সজ্জিত করার ব্যাপারে আমিও টুকিটাকি পরামর্শ দিলাম। 

যাত্রা : শুত্রুবার বিকাল সাড়ে তিনটায় কাকা বাজনদল পরিবেষ্টিত হয়ে আমার হাত ধরে টোপর মাথায় ময়ূরপঙ্খীতে গিয়ে উঠলেন। দেখলাম আমার বাবা মা এবং বাড়ির আরও কয়েকজন লোকজনও আমাদের সঙ্গে এসেছেন। নদীর বুকে ভাসমান ময়ূরপঙ্খী রূপকথার স্বপ্নপুরীর মতোই মনে হচ্ছিল। ব্যাটারির সাহায্যে নৌকায় রঙিন বিদ্যুতের আলোরও ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আমি বললাম, হুররে। এমনি না হলে বিয়ে আর বিয়ে, কাকা। আমার খুব মজা হচ্ছে। 

বর্ণনা : বিয়ের অনুষ্টানের কারণে আমাদের কারো মাঝেই যেনো আর আনন্দ ধরে না। সবাই আনন্দ আর হৈচৈয়ের মধ্যে যাত্রা শুরু করলো। তরফপুর ভাটি অঞ্চল। তাই আশ্বিনের সময় নদী কানায় কানায় ভরা থাকে। স্রোতের অনুকূলে আমাদের যাত্রা হলেও বিপরীত বাতাসে টুলারের বিশাল রূপসজ্জার কারণে বিরাট বাধার সৃষ্টি হচ্ছিল তাই ভয়ের সাথে সাথে বেশ মজা পাচ্ছিলাম। কাকা ছইয়ের ওপরে রাজকীয় অথবা সদাগরী এক ভাব ভঙ্গিতে আসন পেতে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছেন। আমিও কাকার পাশে। দেখলাম উভয় পাশে সাত - আট জন মাঝি দাঁড় টানছে। নৌকায় মৃদু মৃদু আবার অর্তাধিক ঝাঁকি লাগছে। বিস্মিত হয়ে বললাম, "কাকা এরা ইঞ্জিন চালাচ্ছে না কেন!" কাকা আমার কানের কাছে মুখ এনে বললেন, "কারণ এটি ময়ূরপঙ্খী আর এটি পালের উপরে চলে ইঞ্জিনে চলে না আগে এই ভাবেই  ময়ূরপঙ্খী নৌকা চলতো বুজলে ভাতিজা"। এ কথায় আমি খুবই চমৎকৃত হলাম। কাকার গলা জড়িয়ে ধরে বললাম, "তুমি না খুবই লক্ষ্মী মানুষ"। নৌকার ভিতরেই বাদ্যবাজনা বেজেই চলছে। সবাই নেচে গেয়ে চলছে। বিয়ের বাদ্যের তালে তালে আমাদের নৌকা সামনে এগিয়ে চলল। বিশ্বকবির লেখা কবিতার একটু অংশ হটাৎ আমার মনে পড়ল, “ভরা নদী ক্ষুরধারা খর পরশা।” তরতর করে এগিয়ে চলছে আমাদের ময়ূরপঙ্খী। নদীর দুই তীরে অসংখ্য মানুষ দাঁড়িয়ে দেখছে আমাদের অবাক করা বর যাত্রা। আকাশের মেঘের আড়ালে বিকেলের মিঠেল রোদ লুকোচুরি খেলাখেলছে। তারই ঠিকরে পড়া ছিটে-ফোঁটা রোদ ছড়িয়ে আছে নদী বন্ধের অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরঙ্গ রাজ্যে। মনে হচ্ছে নদীবক্ষে কেউ যেন ঢেলে দিয়েছে গলিত সোনা। দুপাশের সবুজ গ্রামের দিকে তাকালাম। সেখানে বৃক্ষপত্রপুটেও চলছে আলো-আঁধারির খেলা। গ্রামগুলোকে স্বপ্নের-রূপকথার সেই রাজকুমারের গ্রাম বলেই মনে হচ্ছে। নিজেকে মনে হচ্ছে কোনো রাজকুমার অথবা সওদাগর পুত্র। আমরা চলেছি দিগ্বিজয়ের নেশায়। খবর এসেছে মহেশপুর গ্রামে দৈত্যরাজপুরীতে বন্দি হয়ে আছে এক রাজকন্যা। তাকে উদ্ধার করতে হবে। আমার কাকাই সেই রাজপুত্র। রাজপুত্ররা সফল হয়—রাজকন্যা উদ্ধারে বিফল হয় না। আমার কাকাও সফল হবেন। হয়তো দেখা যাবে। আগামীকাল সকালেই বিজয় বাদ্যের তালে তালে আমাদের ময়ূরপঙ্খী রাজকন্যাকে উদ্ধার করে নিয়ে ফিরে আসছে। মনে মনে গান গেয়ে উঠলাম ‘তোরা কে কে যাবি আয় সাত মাল্লার দাঁড় টানা ময়ূরপঙ্খী নায় । কাকার ডাকে আমার ধ্যান ভাঙল, কি রে ভাগ্নে। নদীর দৃণ্য দ্যাখ। কি মনোরম তাই না। আমি বললাম, শুধু মনোরম নয় কাকা বলতে পারো অপূর্ব। নদী তীরের অভিন্ন দৃশ্যরাজি নদীবক্ষের ফেনায়িত বিপুল জলরাশি, মাথার ওপরের শরৎ সন্ধ্যার আবির রঙের আকাশ, দক্ষিণা হিমেল হাওয়া এ যে স্বর্গকেও হার মানায়। বাংলার এ দৃশ্য না দেখলে তার এ দেশের অনেক কিছুই অদেখা থেকে যাবে। সন্ধ্যার প্রাক্কালে, মনে হচ্ছে সাতসমুদ্দুর তের নদী পাড়ি দিয়ে আমাদের ময়ূরপঙ্খী ঝামার ঘাটে ভিড়ল। খবর পেলাম আমাদের বাস অনেক আগেই সেখানে পৌঁছে গেছে। 

উপসংহার: কাকার শ্বশুরবাড়িতেও দেখলাম রাজকীয় সাজসজ্জা। বাড়ির সামনের চত্বরে ডেকরেটরদের সাহায্যে কৃত্রিম রাজপ্রাসাদ তৈরি করা হয়েছে। পল্লী বিদ্যুতের কল্যাণে হাসছে যেন সারা প্রাসাদ। আমাদের প্রাসাদতোরণে প্রবেশে বাধা দিল রাক্ষস-দারোয়ানেরা। কিন্তু হলে কি হবে। কাকা খুবই সাহসী ছিলেন। সসৈন্যে তিনি বীর দর্পে দারোয়ানের বাধা উপেক্ষা করে প্রাসাদে ঢুকে পড়লেন। সারারাত রাক্ষসদের খাসি-মোরগ-গরুর সাথে যুদ্ধ করে রাজকন্যা উদ্ধার সম্ভব হলো এবং তাকেসহ ময়ূরপঙ্খীতে চড়ে বিজয়বাদ্য করতে করতে আমরা দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। পেছনে পরাজিত রাক্ষস সেনারা তখনো দ্রিম দ্রিম করে বাজি ফুটিয়ে আমাদের ভয় দেখাবার চেষ্টা করছিল। আমরা কোনো পরওয়া করলাম। নির্ভয়ে আমরা পাড়ি জমালাম।